সিএনএনের সম্পাদকীয়

কোরআনের বাণীতে ট্রাম্প প্রশাসনকে যে বার্তা দিলেন ইমাম

 170121140223-imam-mohamed-magid-january-21-2017-exlarge-169প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য একটি আন্তঃধর্মীয় ধর্মীয় প্রার্থনা অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন থেকে দুটি আয়াত পাঠ করে নতুন প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনের জন্য স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা দিলেন ওয়াশিংটনের একজন ইসলামি ধর্মীয় নেতা।

শনিবার ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ক্যাথেড্রালে বিভিন্ন ধর্মের মোট ২৬ জন ধর্মীয় নেতা ট্রাম্পের জন্য প্রার্থনা করেন। ইমাম মোহাম্মাদ মাজিদ হচ্ছে তাদেরই একজন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই ধরে নিয়েছিল মোহাম্মদ মাজিদ হয়ত নামাজ সম্পর্কে কিছু একটা বলবেন। কিন্তু এর পরিবর্তে কোরআনের দুটি আয়াত পাঠের মাধ্যমে মাজিদ চেয়েছেন ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের শিক্ষা দিতে আর তা হচ্ছে, জাতিগত এবং ধর্মীয় বিবাদ ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়।

ইমাম মোহাম্মাদ মাজিদ ‘অল দিউলেজ এরিয়া মুসলিম সোসাইটির’ নির্বাহী পরিচালক। তিনি ওয়াশিংটনের একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তবে, শনিবারের ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সম্মত হওয়ার জন্য কিছু মুসলিম ব্যক্তিত্ব কঠোরভাবে তার সমালোচনা করেছেন।

আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্টের উদ্বোধনী ঐতিহ্য হিসেবে এই প্রার্থনা অনুষ্ঠান প্রথম প্র্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের সময় থেকেই প্রচলিত হয়ে আসছে। ওই অনুষ্ঠানে বলা হয়, মাজিদ মুসলিমদের প্রার্থনা সম্পর্কে কিছু পাঠ করবেন। নেতৃস্থানীয় অনেকেরই বিশ্বাস ছিল তিনি একটানা আজানের সুরে তা পাঠ করে যাবেন।

এর পরিবর্তে, মাজিদ কোরআন থেকে দু’টি আয়াত বেছে নেন; যে আয়াতে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। বিশেষত জাতিগত এবং ধর্মীয় বিবাদের বিষয়ে। যখন অনেক আমেরিকান মুসলিমদের নিয়ে বিভিন্ন সন্দেহ পোষন করছেন তখন তিনি এ দু’টি আয়াত পাঠ করাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইকেল পেন্সের পরিবারসহ ট্রাম্প-অনুসারীদের উদ্দেশ্যে মাজিদ আয়াত দুটি প্রথমে আরবিতে পাঠ করেন এবং তারপর তা ইংরেজিতে অনুবাদ করে শোনান।

প্রথম আয়াতটি তিনি সূরা আল-হুজারাত থেকে পাঠ করেন। যেটিতে মহান আল্লাহ্ বলেছেন, ‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে একক পুরুষ ও নারী হিসেবে সৃষ্টি করেছি (আদম এবং ইভ) এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্র এবং সম্প্রদায়ে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিতি হতে পার। প্রকৃতপক্ষে, তোমাদের মধ্যে যারা অধিক ধার্মিক, তিনি তার প্রভুর দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে অবগত …।’

দ্বিতীয় আয়াতটি তিনি সূরা আর-রাহমান থেকে পাঠ করেন। এতে বলা হয়েছে, ‘আর আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শনের অন্যতম হচ্ছে আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও গায়ের রংয়ের তারতম্য। নিঃসন্দেহে এসব নির্দেশন তাদের জন্যে; যারা আমার সম্পর্কে জানে।’

মাজিদের একজন মুখপাত্র জানান, তার পাঠ করা কোরআনের এই আয়াত সমূহ ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ক্যাথেড্রালে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করেছে।

‘অল ডিউলেস এরিয়া মুসলিম সোসাইটির’ বোর্ড চেয়ারম্যান ড. রিজওয়ান জাকা বলেন, ‘নির্বাচনের পরেও যখন মুসলমানদের সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে এবং মুসলমানদের আনুগত্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এই আয়াত সমূহের মূল বার্তা হচ্ছে, যে আমাদেরকে অবশ্যই একসঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে হবে এবং বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে হবে এবং মহান আল্লাহ আমাদের এই পথেই তৈরি করেছেন।’

মাজিদের মতো ক্যাথেড্রালের ডিন রেভারেন্ড রানডলফ মার্শালও ট্রাম্পের প্রার্থনার জন্য দেশের বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক বিষয়টি বেছে নেন। তিনি বলেন, ‘যে দেয়াল আমাদেরকে পৃথক করে, তা ভেঙ্গে ফেলার জন্য ঈশ্বর আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ‘অহংকার’ ও ‘বিদ্বেষ’ যা আমাদের হৃদয়কে সংক্রমিত করে, তা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।’

এদিকে, ট্রাম্পের জন্য ওই প্রার্থনা সভায় অংশ নিতে সম্মত হওয়ার জন্য কিছু আমেরিকান মুসলিম মাজিদের তীব্র সমালোচনা করেছেন।

ইসলাম সম্পর্কে বিদ্বেষপূর্ণ ইন্ধন জোগানোর জন্য অনেক আমেরিকান মুসলিম ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছেন। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় মুসলমান, মেক্সিকান এবং নারীদের সম্পর্কে কঠোর ভাষায় বিভিন্ন মন্তব্য করেন।

ওই সময়ে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘ইসলাম আমাদের ঘৃণা করে’। মুসলমানদের ওপর নজরদারি করার জন্য তাদের সম্পর্কে রেজিস্ট্রি রাখারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও, তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, ক্ষমতায় আসলে তিনি মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করবেন।

ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইকেল ফ্লিন ইসলাম ধর্মকে একটি ‘ক্যান্সার’ বলে অভিহিত করেন।

শনিবারের ওই প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আগে লস এঞ্জেলেস চ্যাপ্টারের আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস কাউন্সিলের প্রধান হুসসাম আয়েলাউস ট্রাম্পকে ‘কোন কাপড় ছাড়া প্রবাদতুল্য সম্রাট’ বা ‘নির্বোধ’ বলে অভিহিত করেন এবং প্রার্থনা সভায় যোগ না দিতে মাজিদের প্রতি আহ্বান জানান।

এক বিবৃতিতে হুসসাম বলেন, ‘ ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে ট্রাম্প ও তার টিমের অনুতাপহীন অপবাদের মুখে এ ধরনের অনুষ্ঠানে প্রতীকী অংশগ্রহণ মুসলমানদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না এবং এর দ্বারা জালেমদেরকে সংশোধনও করা যাবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘অনেক মুসলমান ও মিত্ররা ট্রাম্পের বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা ও প্রস্তাবকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এই প্রার্থনা সভায় মাজিদের অংশ নেয়ার কারণে তাদের সাহসী এবং নীতিগত সক্রিয়তাকে খাটো করা হয়েছে।’

জবাবে মাজিদ বলেন, ‘ইসলামের মূল্যবোধ ও প্রকৃত সত্য ক্ষমতাসীন ব্যক্তিসহ সকল মানুষের কাছে তুলে ধরাই হচ্ছে ধর্মীয় নেতাদের দায়িত্ব।’

লেখক ড্যানিয়েল বার্ক, সিএনএনের ধর্মীয় সম্পাদক। ভাষান্তর মো. রাহুল আমীন


শেয়ার করুন