কেমন আছে আসামের বাংলাভাষী মুসলমানরা

নতুন বার্তা ডেস্ক:

গৌহাটি: যেদিন লোকসভা নির্বাচনে জিতে যেদিন নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেন, তার কয়েকদিন আগেই আসামের বরপেটা জেলায় মানস অভয়ারণ্যের ধারে নঙ্কাই খাগরাবাড়ী গ্রামে বাংলাভাষী মুসলমানদের ওপরে আক্রমণ ঘটেছিল।

সিরাজ আলির স্ত্রীকে গুলি করে মারা হয়, দুবছরের মেয়েকে আগুনে ফেলে দেওয়া হয় – আর সাত বছরের বড় মেয়ের দেহ পাঁচ দিন পরে পাওয়া গিয়েছিল। আরেক বাসিন্দা রমজান আলি তার পরিবারের পাঁচজনকে হারিয়েছেন।
সন্দেহভাজন বোড়ো জঙ্গিদের আক্রমণে ডিসেম্বরের শেষে মারা গেছেন প্রায় সত্তর জন আদিবাসী নারী, পুরুষ আর শিশু। ওই আক্রমণের পর থেকে বাংলাভাষী মুসলমানদের আতঙ্ক আরও বেড়েছে।

আসামের বাংলাভাষী মুসলমানেরা সেই ১৯৫০ সাল থেকেই বারে বারে আক্রমণের মুখে পড়েছেন। সেই ভয়াবহ চরুয়া খেদা দাঙ্গায় একটি মুসলমান গ্রামেই আটশো মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন গবেষক ভাস্কর নন্দী।
তার কথায়, “দাঙ্গার আতঙ্কে হাজার হাজার মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। নেহরু-লিয়াকত চুক্তি অনুযায়ী তাদের ভারত ফেরত নেয় ঠিকই কিন্তু সীমান্ত পেরনোর সময়ে সঠিক নথিপত্র দেওয়া হয় নি। আর ওই শরণার্থীরা ফেরত আসার আগেই ১৯৫১ সালে আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা National Register of Citizenship (NRC) তৈরি হয়ে যায়। তাই বহু বাংলাভাষী মুসলমানেরই আর সেই NRC তে নাম ওঠে নি।”
আর সেই সুবাদে নয়ের দশক থেকে বহু বাংলাভাষী মুসলমানকেই সন্দেহজনক ভোটার বা D Voter, অর্থাৎ সন্দেহজনক বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করা হয়ে গেছে।
আসাম চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরে যারা আসামে এসেছেন, তাদেরই বিদেশী বলে চিহ্নিত হওয়ার কথা।
কিন্তু বরপেটার নারায়নগুড়ি গ্রামের এক প্রধান শিক্ষক আমজাদ আলি বলছিলেন, “বাবার ১৯৩৭ সালে আসামে ম্যাট্রিক পাশ করার সার্টিফিকেট থাকা স্বত্ত্বেও তাকে সন্দেহজনক ভোটার অর্থাৎ সন্দেহজনক বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল।”
সন্দেহজনক ভোটার বলে চিহ্নিত হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ- বেশিরভাগই বাংলাভাষী মুসলমান।
এই কথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বা বিদেশীদের ভারত ছাড়া করার কথা সবসময়েই বলে এসেছে উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলো। সেই দাবিকেই সামনে নিয়ে এসেছে ভারতীয় জনতা পার্টি।
লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে নরেন্দ্র মোদি বারে বারেই আসামে এসে বিদেশী চিহ্নিতকরণ আর বিতারণের হুমকি দিয়ে গেছেন। কিন্তু কে যে আসলে ভারতীয় বাংলাভাষী মুসলমান আর কে কথিত অনুপ্রবেশকারী তা জানার একমাত্র উপায় nrc যেটা হালনাগাদ করার কাজটাই গত ৬৫ বছরে করা হয় নি। রাজনৈতিক দলগুলো এ জন্য একে অপরকে দোষ দেয়।
মুসলিম ছাত্র নেতা রফিকুল ইসলামের কথায় এনআরসি হালনাগাদ হয়ে গেলে বিদেশী ইস্যুও থাকবে না, তখন বিভিন্ন দলের রাজনীতি চলবে কী করে!
অক্টোবরের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে ঘটা একটা বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা যে কথিত জঙ্গী চক্রের সন্ধান পেয়েছেন, তারসঙ্গে এই বরপেটার কয়েকজন বাঙালি মুসলমানের যোগসূত্র পাওয়া গেছে বলে দাবী তদন্তকারীদের। গ্রেফতারও হয়েছেন কয়েকজন, আর তারপর থেকেই শুরু হয়েছে সন্দেহ আর হেনস্থা।
মুসলিম ছাত্র সংগঠন এ বি এম এস ইউ-র সভাপতি রফিকুল ইসলামের কথায়, আসামে বাংলাভাষী মুসলমান দেখলেই এখন জেহাদি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
আসামের বাংলাভাষী মুসলমানদের আতঙ্কের আর অনিশ্চয়তা শেষের আশা তাই কেউই খুব একটা দেখতে পাচ্ছেন না, অন্তত অদূর ভবিষ্যতে।
আর বিশ্লেষেকরা মনে করছেন, এই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা আরও বেশিদিন চলতে থাকলে তার সুযোগ নিতেই পারে উগ্র ধর্মীয় চিন্তার রাজনীতি। আসামের বাংলাভাষী মুসলমানদের একটা বড় অংশেরও সেটাই ভয়।- বিবিসি


শেয়ার করুন