কুয়াকাটা : সময় যেখানে স্বপ্নমাখা

ুুুুুু‘সাগরকন্যা তুমি মিশেছ দিগন্তে কিন্তু কখনো মেশোনি আকাশের সাথে। তোমার তোলপাড় করা রুপ মুগ্ধ করেছে বারবার।’ কুয়াকাটা ঘুরতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিয়ে এভাবে লিখেছিলেন কবি। এই কবির মতোই কুয়াকাটা ঘুরতে যাওয়া সব দর্শনার্থীও মুগ্ধ হবেন সাগরকন্যার সৌন্দর্যে।

পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই শনিবার (৯ এপ্রিল) রাতে হঠাৎ করেই আমরা ৩০ জন বন্ধু রওনা করি কুয়াকাটার পথে। বড় বাস পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই আমরা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কেউ লঞ্চে, কেউ বাসে আবার কেউবা মাইক্রোবাসে কুয়াকাটা পৌঁছাই।

১০ এপ্রিল সূর্য ওঠার আগেই আমরা কুয়াকাটা পৌঁছালাম। মোটেলে গিয়ে ব্যাগটা রেখেই দে ছুট। দেখতে হবে সূর্যোদয়। কুয়াকাটায় যেখান থেকে সূর্যোদয় দেখা যায়, সেখানে পৌঁছানোর একমাত্র বাহন মোটরসাইকেল। ৩০ জন ১৫টি ভাড়া করা মোটর সাইকেল নিয়ে বের হলাম সূর্যোদয় দেখার জন্য।

মোটরসাইকেলের বিশাল বহর দেখে সৈকত পাড়ের লোকজনের কৌতূহলের শেষ নেই। একজন তো জিজ্ঞেস করেই বসলেন, আমরা কোনো রাজনৈতির দলের লোক কি না? ভাড়া করা মোটরসাইকেল দিয়েই আমরা ‘বাইক রেস’ খেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। সৈকতে ১ ঘণ্টা চললো আমাদের বাইক রেস।

সেখান থেকে আমরা চলে গেলাম কাঁকড়া দ্বীপে। লাল লাল বেশ বড় কাঁকড়ার দেখা মিলল সেই দ্বীপে। একে একে আমরা গঙ্গারচর, ছোট একচিলতে একটা নদী, রাখাইনদের মিস্ত্রিপাড়াসহ কাছাকাছি সব এলাকা ঘুরতে থাকলাম। এই মিস্ত্রিপাড়ায় আছে ৩৫ ফুট উঁচু বিশাল বুদ্ধমূর্তি। ওখানেই দেখলাম কী সুন্দর করে রাখাইন ছেলেমেয়েরা তাঁত বোনে।

এরপর ট্রলারে করে আমাদের ফাতরার চরের উদ্দেশে যাত্রা। অনেকে জানান, ফাতরার চর আসলে সুন্দরবনের বিচ্ছিন্ন একটা অংশ। সত্যিই তাই! ট্রলারে বসে ফাতরার বনে দেখা পেলাম কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী, গরান, বাইন, গোলপাতা ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ।

বিকেলে মোটেলে যখন ফিরলাম তখন সবার চোখেই রাজ্যের ঘুম। খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই সেই রাজ্যে হারিয়ে গেল সবাই। ঘুম থেকে উঠে রাত সাড়ে ৮টার দিকে আবার যাই সৈকতে। রাতের সৈকত সৌন্দর্যের অন্য এক মাত্রা নিয়ে হাজির আমাদের সামনে। বিশেষ করে শীতল বাতাস যখন শরীরে লাগে, তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান এবং সুখী মানুষ বলে মনে হয়। এরমাঝে হঠাৎ দেখা মেলে এক বাউল শিল্পীর। তার গান, সমুদ্র আর খোলা আকাশ পুরো সৈতকজুড়ে তৈরি করে অন্যরকম এক আবহ। সবকিছুর মিথষ্ক্রিয়ায় বিলীন হয়ে যাই আমরা সবাই, হারিয়ে যায় নাগরিক ইট আর ইঞ্জিনের গল্পগুলো। সেসব ছেড়ে রাত ১টার দিকে সৈকত থেকে আবার আমাদের মোটেলে ফেরা। এরপর ঘুম।

দ্বিতীয় দিনে আমাদের পরিকল্পনা ছিল পুরো সময়টা সাগরের পানিতে কাটানোর, সাগর পাড়ে খেলাধুলা করা আর সূর্যাস্ত দেখার। সে অনুযায়ী সকালের নাস্তাটা সেরেই সৈকতে হাজির প্রত্যেকে। সাগরের পানিতে দু’পা ভেজাতেই মন আনন্দে ভরে উঠল। এরপর আস্তে আস্তে হাঁটু পানিতে, তারপর গলা পানিতে নামতে শুরু করল সবাই। সাগরের ঢেউ শরীর এসে আছড়ে পড়ার অনুভূতিটা একেবারেই আলাদা। ঢেউগুলো কখনো খুব গভীরে টেনে নিতে চায় সবকিছু, কখনো আবার সৈকতে ফিরিয়ে দেয় অভিমানী কিশোরের মতো করে। যেন জীবনযুদ্ধের যত দ্বিধা, সবকিছুর প্রকাশ সমুদ্রের এই ঢেউগুলোতে।

এরপর দু’টি গ্রুপে ভাগ হয়ে শুরু হয় আমাদের ‘বিচ ফুটবল।’ খেলার শুরুতেই বিপত্তি দেখা দিল, গোলরক্ষক নিয়ে। সবাই স্ট্রাইকার হতে চায়, গোলরক্ষক হবে না কেউ। খেলার ১৫ মিনিটের মধ্যে এক গ্রুপ গোল খেয়ে বসলেও রেফারি অফসাইডের দোহাই দিয়ে গোলটি বাতিল ঘোষণা করলেন। এ নিয়ে তুমুল বাগবিতণ্ডা। কিছুক্ষণের বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয় খেলা। ততক্ষণে সূর্য মাঝআকাশে।

দুপুরের পর্ব শেষে আমাদের অপেক্ষা ছিল সূর্যকে বিদায় দেয়ার। বাধ সাধলো প্রকৃতি। মেঘ আর সমুদ্রের বন্ধুত্বটা যে বহু পুরোনো। বিশাল সমুদ্রের উপরে বিশাল বিশাল মেঘের খণ্ড ঢেকে দিল সূর্যটাকে, পুরো আকাশটাই লুকিয়ে গেল মেঘের আড়ালে। সূর্য ডোবাটা দেখা হলো না, কিন্তু চোখের সামনেই সূর্যটা ডুবে গেল, একটু একটু করে। সাগরকন্যার শরীরটাও ধীরে ধীরে আবছা হয়ে এলো। থামলো না কেবল তার গর্জন। সে দৃশ্য! তার তুলনা আর কীসের সঙ্গেই বা চলে!

দুদিনের সফর শেষে আমরা যখন আবার ঢাকার পথে, শরীরটাই কেবল ছিল চলন্ত বাসে। আত্মা আর সাগরকন্যা তখনো মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, স্মৃতিতে তখনও, মেঘ-সমুদ্রের বন্ধুতা। রাত বাড়ছিল, বাড়ছিল সমুদ্রের সঙ্গে দূরত্ব। তখনো কোথাও ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছিল, চোখে ঘুম…


শেয়ার করুন