কক্সবাজারে সদরে ‘খাল দখল’ করে মৎস্য ঘের, এলাকাবাসীর ক্ষোভ

ডেস্ক নিউজঃ

কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা এবং পিএমখালী ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পাতলী খাল। এই উম্মুক্ত খালে মৎস্য আহরণ করেই চলতো দু’পাড়ের সহস্রাধিক পরিবারের সংসার। বর্তমানে তারা পড়েছেন মহা বিপাকে।

অভিযোগ উঠেছে, গত ১ বছর ধরেই ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পাতলী মাছুয়াখালী খালে আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়াসহ খালের দেড় কিলোমিটার জুড়ে দুটি বাঁধ দিয়ে জবরদখল করে মাছ চাষ করছে পিএমখালী ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড আ.লীগের সভাপতি নুরুল আবছার।

সরেজমিনে দেখা যায়, পিএমখালী ইউনিয়নের উত্তর পাতলী মোহসিনিয়া পাড়া পর্যন্ত মাঝখানের অংশের প্রায় দেড় কিলোমিটার খালে দুটি বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এতে খালের জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। আবার বাঁধের পাশে ঘর নির্মাণ করে সেখানে মাছের খাবারসহ বিভিন্ন মালামাল রাখা রয়েছে।

এসময় কথা হয় স্থানীয় কয়েকজনের সাথে। তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে এখানে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা হচ্ছে। খালতির মাঝখানের পুটখালীর একটি কালভার্টের পাশে এই বাঁধ দিয়ে ঘেরের দুটি অংশ ভাগ করা হয়েছে।

স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের লোকজনই প্রভাব খাটিয়ে খালটিতে মাছ চাষ করে। খালে বাঁধ দেওয়ার কারণে একদিকে এটি ছোট হচ্ছে, অপরদিকে স্থানীয় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তাদের মতে, ভরাট হয়ে যাওয়া এই খালে চাষাবাদ ও মৎস্যজীবিদের সুবিধার্থে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে খালটির কিছু অংশ খনন করে বিএডিসি কতৃপক্ষ। খননের পর বাঁধ দিয়ে মাছ চাষে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্মৃতিবিজড়িত এই খাল আজ বিপন্ন হয়ে উঠেছে। তাছাড়া বাঁধের কারণে খালের প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় হুমকির মুখে রয়েছে ২০ হেক্টর জমির ধানসহ বিভিন্ন শাক-সবজি।

স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খালটির বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন জন বাঁধ দিয়ে কেউ মাছ চাষ করছে, কেউ বা ভরাট করে বাড়িঘর তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ফলে শতবর্ষী খালটি শিগগিরই তার অস্তিত্ব হারাতে বসছে। জবরদখলে খালটি বিপন্ন হওয়ায় ঝিলংজা এবং পিএমখালী ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে কৃষি সেচ ব্যবস্থা এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। চলতি বর্ষায় যেমন দীর্ঘ মেয়াদি জলাবদ্ধতায় কৃষকের ফসল ডুবির শঙ্কা দেখা দিয়েছে তেমনি শুষ্ক মৌসুমে সেচের অভাবে কৃষি চাষ বিঘ্নিত হবে।

শতবর্ষী খালটি জবরদখল করে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করায় দীর্ঘ খালটির আশপাশের কয়েক গ্রামের সহস্রাধিক কৃষকের সেচনির্ভর কৃষি যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি দীর্ঘ মেয়াদি জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে রয়েছে বিস্তৃত জনপদ। জবরদখল করা খালটি উদ্ধার চেয়ে সম্প্রতি সময়ে স্থানীয় কৃষক ও জেলেরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগ করার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি উপজেলা প্রশাসন।

স্থানীয় কৃষকরা অভিযোগ করেন, পিএমখালীর ৭নং ওয়ার্ড আ.লীগের সভাপতি নুরুল আবছার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পাতলী খালের অংশে একাধিক বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। স্থানীয় কৃষকরা ও গ্রামবাসী বাধা দিলেও সব বাধা উপেক্ষা করে তিনি ওই খালটিতে পানি নিষ্কাশন বন্ধ করে জবরদখল করে নেন।

স্থানীয় কৃষক মো. মাসুদ জানান, খালটি বন্ধ করে দেওয়ায় আবাদি জমিতে তীব্র জলাবদ্ধতা হয়। পানি নিষ্কাশনের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতার কারণে নষ্ট হচ্ছে কৃষকের ফসল। এছাড়াও ইরি মৌসুমে পানির সংকটে ইরি চাষ ব্যাহত হচ্ছে।

তথ্য সূত্রে জানা যায়, ঝিংলজা ও পিএমখালী ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়াউর রহমান নিজে এসে মানুষজন নিয় খালটি খনন করছিলন। কিন্তু কালক্রমে খালটি নানা কারণে ছোট ও ভরাট হয় গেছে। তার উপর রয়েছে দখলদারদের থাবা। এরমধ্যে ঝিলংজার মাষ্টার পাড়ায় দখল হয় সবচেয়ে বেশি।

অভিযোগ দায়েরকারী কৃষক নুরুল কবির জানান, ঐতিহ্যবাহী খালের উপর বাঁধ দেয়ায় ওই খালের পানি দিয়ে সেচ করতে পারছেনা শতশত কৃষক। লাখ লাখ টাকা খরচ করে খালটি খনন করার পরও বর্তমানে তাদের কোন কাজে আসছেনা খালটি।

স্থানীয় জেলে মোজাম্মেল হক বজল কবির ও আবছার বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষরা এই খাল থেকে মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আমাদের প্রায় সহস্রাধিক জেলে পরিবারের সংসার চলে এই খালের মাছ শিকার করে। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা খালে বাঁধ দেন। ফলে এ খালে মাছ শিকার ও চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। তারা এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের সহযোগিতা কামনা করেন।

জানতে চাইলে খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের বিষয়টি স্বীকার করেন অভিযুক্ত পিএমখালী ইউনিয়েনের ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আবছার।

তিনি বলেন, খালটিতে সময় মতো পানি না থাকার কারণে জমিতে সেচ দিতে অসুবিধা হয়। একারণে বাঁধ দিয়ে পানি জমা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি কিছু মাছও চাষ করা হয়েছে।

এতে খালের প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় উপকারভোগী লোকজন ক্ষতির মুখে পড়েছেন; এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তারা অহেতুক এইসব অভিযোগ করছেন, এতে কারো তেমন কোন ক্ষতি হওয়ার কথা না। তারপরও প্রশাসন যদি তাই মনে করে তারা বাঁধগুলো কেটে দিতে পারেন বলে জানান এই আ.লীগ নেতা।

বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি শামশুল আলম শ্রাবণ বলেন, নদী-খাল কোনো ব্যক্তিমালিকের হয় না, এগুলোর মালিক জনসাধারণ। নদী-খালের পানি ও মাছের ওপর কোনো ব্যক্তি, সংঘ, সংস্থা বা দলের একচ্ছত্র অধিকার নেই। দখল-দূষণের ফলে নদ-নদীর গভীরতা কমে যায়। ফলে নদীতে বসবাস করা জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব হারানো আশঙ্কা থাকে। নদী সরু ও গভীরতা কমে যাওয়ায় আশপাশের এলাকা বর্ষাকাল ছাড়াও জোয়ারে প্লাবিত হতে পারে।

তিনি আরোও বলেন, নদ-নদী রক্ষার বিষয়ে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট রায় রয়েছে। প্রতিটি জেলায় দখলদারদের তালিকা করার নির্দেশনাও রয়েছে ওই রায়ে। দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করে অতিদ্রুত একে দখলমুক্ত করার দাবি জানান তিনি।

কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, পিএমখালীতে খাল দখল করে মাছ চাষের বিষয়টি আমরা জেনেছি। সময়ের অভাবে বাঁধ অপসারণ করতে যেতে পারছিনা। প্রভাবশালী যতবড় শক্তিশালী হোক সরকারী সম্পত্তি রক্ষা করতে অতিসত্বর অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে


শেয়ার করুন