কক্সবাজারে ধর্মীয় সহিংসতা এবং মানবতাবোধ

Ing. Bodiul Alamইঞ্জিনিয়ার বদিউল আলম

প্রতিবছর ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর এলেই স্মৃতি রোমন্থনে শিহরিত হই এবং বেদনায় কাতর হয়ে পড়ি। কারণ ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২, কক্সবাজারের ইতিহাসে দু’টো কালো দিন। সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ধ্বংস সাধন করে কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক তথাকথিত কিছু মুসলিম জানোয়ার। অবশ্য ঘটনার ব্যাপকতার প্রতিরোধে অংশ নেয় সরকারি প্রশাসন ও স্থানীয় সচেতন জনতা। কক্সবাজারের সচেতন জনতা যারা এই সকল ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন তারা সবাই ধিক্কার দিয়েছেন ওই অমানুষদের। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক মহামতি গৌতম বুদ্ধের ত্রিপিটকের এই অমর বাণীটি হচ্ছে “সব্বে সত্ত্বা সুখিতা হোন্ত” অর্থাৎ জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। বিগত প্রায় ২৬০০ বছর ধরে অদ্যাবধি বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ বৌদ্ধ ধর্মানুসারী হয়েছে গৌতম বুদ্ধের সেই অমোঘ বাণীকে হৃদয়ঙ্গম ও জীবনে ধারণ করে। তারপরবর্তী সময়ে সারা ভারত সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ক্রমান্বয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রসার লাভ করে। তবে পাল যুগ থেকে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও বহুল ব্যপ্তি ঘটে রাজকীয় আনুকুল্যের বদৌলতে।
বিগত সময়ে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অন্যান্য ধর্মের মতো বৌদ্ধধর্ম ও বাংলাদেশে যথাযথ মর্যাদায় অনুশীলিত হয়ে আসছে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বাংলাদেশের অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মতো সমমর্যাদা সম্পন্ন শান্তিপ্রিয় স্বাধীন নাগরিক। সে বিবেচনায় বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার দেশের সকল সংখ্যালঘু বিশেষ করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। শুধু তাই নয়, তারা যথাযথ যোগ্যতার মাধ্যমেই বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উচ্চপদে ও পেশায় নিয়োজিত থেকে দেশ গঠনে অংশীদার।
মহামতি গৌতম বুদ্ধের আরেক অমর বাণী “অহিংসা পরম ধর্ম”। সেই বাণীকে ধারণ করে বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে সৌভ্রাত্ববোধ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে ধর্মীয় জীবন যাপন ও আচার অনুষ্ঠান পালন করেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
কিন্তু সেই শ্বাশত ধারাকে ব্যতয় ঘটিয়ে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে রামু, উখিয়া ও টেকনাফে বকধার্মিক ও জঙ্গীবাদী কিছু মানুষ কলংকময় ইতিহাস রচনা করল। প্রকৃত কোন কারণ ব্যতিরেখে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়ীঘর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বর্বরতার শিকার হলো। ওই অমানবিক ঘটনা কোন প্রকৃত ধার্মিকের কাছে অতি ঘৃণ্য। তাতে আল্লাহপাক এবং ইসলাম লজ্জিত ও দুঃখিত হয়েছে। সেই জঘন্য ঘটনায় বিশ্বের কোন দেশ এমনকি কোন মুসলিম দেশ ও স্বাগত জানায়নি ওই অমানুষদের। বরং নিন্দিত হয়েছে গোটা বাংলাদেশ তাদের কারণে। সেই পাশবিক ধ্বংসযজ্ঞে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে।
আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন “তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করিওনা, অতীতে সেই কারণে অনেক ধর্ম ধ্বংস হয়েছে”। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে “লাকুম দীনাকুম ওলিয়াদ্বীন” অর্থাৎ যার ধর্ম তার তার জন্য। এই বিষয়ে কোরআন ও হাদিসে আরো অনেক আয়াত রয়েছে। অবশ্য ইসলামে সংখ্যালঘুদের সম্মান ও সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা আছে। ইসলাম অর্থ শান্তি। সুতরাং শান্তির ধর্মের প্রকৃত কোন মুসলমান ওই কলংকিত ঘটনার অংশীদার হতে পারেন না। আক্রমণকারীরা প্রকৃত ইসলামের আদর্শকে ধারণ করেন না।
পৃথিবীর সকল ধর্মে দেখতে পাই যে, মানবজীবনকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে মানুষকে “আশরাফুল মাখলুকাত” অর্থাৎ সৃষ্টির সেরাজীব। বৌদ্ধধর্মে মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ গুণকীর্তন এবং মানবজীবন অর্জন অতি দুর্লভ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মের ভগবদ গীতায় বলা হয়েছে “মনুষ্যং অমৃতস্য পুত্রং” অর্থাৎ মানুষ অমৃতের পুত্র। এইভাবে খ্রিস্টান, ইহুদী ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মেও মানুষ এবং মনুষ্যত্বকে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং ধর্মীয় সহিংসতায় নির্যাতিত মানুষের স্বপক্ষে অন্যান্য ধর্মীয় মানুষের অবস্থান নেয়ার অর্থই মানবতাবোধ।
অবশ্য রামু, উখিয়া ও টেকনাফের ধর্মীয় সহিংসতার পেছনে উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের গভীর ষড়যন্ত্র লুকায়িত আছে। এখানে বাংলাদেশী উগ্র সাম্প্রদায়িক মানুষের সাথে মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততা দেখতে পাই। এ বিষয়ে মায়ানমার সরকারকে তাদের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের প্রতি বিনয়, শ্রদ্ধা এবং তাদের সমমর্যাদা সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এবং তথায় বসবাসরত রাখাইনদেরকেও সেই মর্যাদা প্রদান করতে হবে। ধর্ম বিবেচনায় কোন জাতি বা নৃ-গোষ্ঠির বিচার অন্যায় ও অমানবিক। তা জাতিসংঘের সনদ বিরোধী।
আসুন আমরা মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সবাই মিলে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করি। এক ধর্ম অন্য ধর্মের শত্র“ নয় বলে মনন-মগজে ধারণ করি। কুসংস্কার, দারিদ্র ও অশিক্ষাই আমাদের শত্র“। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এই দেশে সকল ধর্মের মানুষ নিরাপদ, সম্মান ও সুখে শান্তিতে বসবাস করুক। আর এখানেই নিহিত আছে ডিজিটাল ও উন্নত বাংলাদেশ। অবশেষে মহামতি বুদ্ধের অমৃত বাণী দিয়েই শেষ করি এ লেখা “বহুজন হিতাযো, বহুজন সুখাযো” অর্থাৎ ‘সকলের মঙ্গল হোক ও সকলের শান্তি হোক’।

লেখকঃ বিশিষ্ট পরিকল্পনাবিদ, সমাজসেবক,
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগ।


শেয়ার করুন