কক্সবাজারে আ. লীগের দলীয় মনোয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপে যারা

আগামী ১১ জাতীয় সংসদ নিবার্চনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোতে তোড়জোড় চলছে। এই নির্বাচনকে নিয়ে কক্সবাজারেও রাজনৈতিক দলগুলো সরব হয়ে উঠেছে। সরকারি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত অঙ্গনে এখন আলোচনা- তাহলো নির্বাচন। নির্বাচনে অংশ নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীরা এরই মধ্যে মাঠে নেমে গেছেন।

তবে বৃহৎ দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে দু’টি বিশাল পার্থক্য ধরা দিয়েছে। তা হলো বিএনপিতে মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসন ছাড়া বাকি আসনগুলোতে প্রার্থী প্রায় চূড়ান্ত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগে চার আসনেই সম্ভাব্য প্রার্থী ছড়াছড়ি। দলীয় মনোয়ন পেতে সবাই দৌড়ঝাঁপ চালাছেন অনেক আগে থেকে। আজকে থাকছে জেলার চার আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন হালচাল।

জানা গেছে, জেলার চার আসনের মধ্যে তিন আসনেই আওয়ামী লীগের সাংসদ রয়েছে। এর মধ্যে মহেশখালী-কুতুবদিয়া ও কক্সবাজার সদর-রামুতে বর্তমান সাংসদরা মনোনয়ন দৌড়ে মোটামুটি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তবে উখিয়া-টেকনাফ আসনে বিতর্কিত সাংসদ আবদুর রহমান বদির মনোনয়নের বিষয়টি অনেকটা অনিশ্চয়তা মধ্যে হাবুডুব খাচ্ছে।

স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন তিন সম্ভাব্য প্রার্থী। তারা হলেন চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জাফর আলম, জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম সজীব ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সাবেক গভর্ণর জহিরুল ইসলামের পুত্র রাশেদুল ইসলাম। এর মধ্যে সজীব ও রাশেদের পৈত্রিক বাড়ি পেকুয়া। এই তিন জনের মধ্যে জাফর আলম গতবারের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। তিনি মনোনয়ন পেতে পেতেই হাতছড়া হয়ে গিয়েছিল। শেষ মুর্হুতে এসে জোটগত নির্বাচন করতে গিয়ে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দিতে গিয়ে তার আর নির্বাচন করা হয়নি। দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে এটি হয়েছিল। তারপরও তিনি হতাশ হননি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মাঠের রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় রয়েছেন। চকরিয়া ও পেকুয়ায় প্রায় সময় দলীয় মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন সামাজিক ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কর্মসূচী করে আসছেন। এবারের মনোনয়ন নিয়ে তিনি খুব সিরিয়াস। শেষ সময়ে তিনি এখন মনোনয়ন নিয়েই বেশি কাজ করছেন। শোনা যাচ্ছে, তিনি দলের নীতি-নির্ধারণী মহলের নিম্নস্তর থেকে হাইকমান্ড পর্যন্ত নিয়মিত লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। আপাতত তিনি মনোনয়ন নির্ভর রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। আশরাফুল মনোয়ন প্রত্যাশীর মধ্যে নতুন হলেও এলাকায় যোগাযোগে তিনি অনেকটা পুরনো হয়ে গেছেন। তিনি গত নির্বাচনের পর থেকে মাঠে নেমেছেন। এলাকার দলীয়, বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক কর্মসূচীতে সময় দিচ্ছেন। এছাড়া এবারের বন্যায় চকরিয়ায় ত্রাণ বিতরণ করে আলোচনায় এসেছেন। অন্যদিকে মনোনয়নের জন্য দলের হাইকমান্ডে চালাচ্ছেন জোর লবিং। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়ের বন্ধু, আরাফাত এ রহমানে খুব সেন্হভাজন আশরাফুল ইসলাম সজীব। আরাফাত এ রহমানের প্রতিষ্ঠিত সুচিন্তার চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়কও সজীব। মূলত আরাফাত এ রহমানের মাধ্যমে জয়ের কাছ থেকেই দলীয় মনোনয়ন পেতে লবিং চালাচ্ছেন।
একইভাবে রাশেদুল ইসলামও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে লবিং চালাচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে একটা ‘গুড রিলেশন’ রয়েছে রাশেদের। এই পাশ থেকে তিনি মনোনয়নের পাওয়ার জন্য তলে তলে জোর লবিং চালাচ্ছে শোনা যাচ্ছে। এই জন্য এরই মধ্যে কয়েক দফা পেকুয়া মিটিংও করেছেন। সব মিলে সকল জল্পনা-কল্পনাকে পাশ কাটিয়ে রাশেদুল ইসলাম মনোনয়ন পেয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মন্তব্য জেলার রাজনৈতিক বোদ্ধাদের।

কক্সবাজার-২-(মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনে এখন পর্যন্ত চারজন মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন। তারা হলেন বর্তমান সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. সিরাজুল মোস্তফা, সাবেক মহাজোট প্রার্থী পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনচারুল করিম ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ওসমান গণি। চারজনের মধ্যে আশেক উল্লাহ রফিক ও ওসমান গণি মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তারা নিয়মিত নির্বাচনী এলাকায় শোডাউন ও মিটিং করছেন। তবে চারজনই মনোনয়ন পেতে দলীয় হাইকমান্ড পর্যন্ত লবিং চালাচ্ছেন। এর মধ্যে আশেক উল্লাহ রফিক চট্টগ্রামের মেয়র আ.জ.ম নাসির আস্থাভাজন মানুষ। তাঁর মাধ্যমে দলীয় হাইকমান্ড ঠিক রেখে মনোনয়নও ঠিক রাখতে জোর লবিং করছেন আশেক উল্লাহ রফিক। ওসমান গণি চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দীনের ছেলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিষ্টার নওফেলের কাছের মানুষ জনশ্রুতি আছে। নওফেলের সাথে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুলের কাদেরের ‘শক্ত লিঙ্ক’ রয়েছে। তাই নওফেলের মাধ্যমে ওবায়দুল কাদেরের আর্শিবাদপুষ্ট হয়ে দলের মনোনয়ন ছিনিয়ে আনার জন্য জোর লবিং করছেন ওসমান গণি। অন্যদিকে ড. আনচারুল করিম ঢাকার স্থায়ী হিসেবে প্রায় সময় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সাক্ষাত পান। তিনি সরাসরি দলীয় প্রধানের কাছে মনোনয়নের জন্য লবিং করছে শোনা যায়। একই ভাবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার বেশ কয়েকবার দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সাক্ষাত পেয়েছেন এড. সিরাজুল মোস্তফা। তিনিও মনোনয়নের জন্য সরাসরি শেখ হাসিনার কাছে লবিং করছে জানা গেছে।

কক্সবাজার-৩ (কক্সবাজার সদর-রামু) আসনের মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন চারজন। তারা হলেন বর্তমান সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহামদ চৌধুরীর স্ত্রী কানিজ ফাতেমা মোস্তাক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান। চারজনই শক্ত মনোনয়ন প্রত্যাশী। এদের মধ্যে নানা কারণে কমলের মনোনয়ন পাওয়া শতভাগ নিশ্চিত নয়। তারপরও তাকে মনোনয়ন পাওয়াকে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেন না। তিনি নিবার্চনী মাঠে শক্ত অবস্থানে থাকার কারণে তাকে অবহেলা করা যাচ্ছে না। এছাড়াও দলীয় স্তরে তার জোর লবিং রয়েছে। কানিজ ফাতেমা গতবারে মনোনয়ন পেয়েও ঋণখেলাপী হওয়ার কারণে শেষ মুহুর্তে নির্বাচন করতে পারেননি। তাই তিনি এবার ‘নাছোড়বান্দা’। যেকোনো উপায়ে মনোনয়ন ভাগিয়ে আনতে তিনি জোর লবিং চালাচ্ছেন। তার স্বামী মোস্তাক আহামদ ছাড়াও পৈত্রিক ভাবেও দলে তাঁর শক্ত অবস্থান রয়েছে। দু’দিক কাজে লাগিয়ে দলের হাইকমান্ড পর্যন্ত তিনি লবিং চালাচ্ছেন। জনশ্রুতি রয়েছে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা কানিজ ফাতেমা মোস্তাককে খুব পছন্দ করেন। এতে করে তার মনোনয়ন পাওয়া খুব দুষ্কর হবে বলে মনে করা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও মনোনয়নের এবার মাঠে নেমেছেন সাংসদ কমলের ছোটবোন নাজনীন সরওয়ার কাবেরী। বাহ্যিকভাবে পারিবারিক সম্পত্তি বিরোধের কারণে ভাইয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া মনে হলেও কাবেরী বিষয়টিকে উড়িয়ে দেন। তিনি মনে করেন, বর্তমান সরকার নারীদের এগিয়ে নিতে কাজ করছেন। তার অংশ হিসেবে নিজে মনোনয়ন চাচ্ছেন কাবেরী। এই জন্য তিনি লবিং করছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক কথা শোনা যায়। মুলত সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে দলীয় মনোনয়ন ছিনিয়ে আনার চেষ্টা করছেন কাবেরী।
জনগণের নেতা হিসেবে খ্যাতি রয়েছে মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যানের। জনগণের জন্য কাজ করতেই তিনি সাংসদ হতে দলীয় মনোনয়ন চাচ্ছেন। জেলা সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কয়েক দফা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার আস্থাভাজনে পরিণত হয়েছেন তিনি। একই সাথে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী সাইফুজ্জামান শিখরের সাথে মুজিব চেয়ারম্যানের একটা ‘শক্ত সম্পর্ক’ রয়েছে। এই দু’য়ে মিলিয়ে মনোনয়ন পেতে লবিং করছেন মুজিব চেয়ারম্যান।

কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে বর্তমান সাংসদ আবদুর রহমান বদি ছাড়া আওয়ামী লীগের শক্ত কোনো প্রার্থী নেই। তবে তিনি নানা কারণে চরম বিতর্কিত একজন সাংসদ। কারণে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে করা হয়। তাই তাঁর মনোয়ন পাওয়াটা দুষ্কর হয়ে যাবে। এই বিষয়টি সামনে এই আসনে মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ চালাচ্ছে সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলী, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহ আলম, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগে সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী। তবে মধ্যে ইয়াবা ব্যবসায়ী পুত্রের অপকের্মর কারণে মোহাম্মদ আলীর মনোনয়ন পাওয়াটা ২০ভাগও সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তারপরও দলের হাইকমান্ডের কাছে লবিং চালাচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। হামিদুল হক চৌধুরীর মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বর্তমানে তিনি গুরুতর অসুস্থ। সে কারণে তিনি নির্বাচনের জন্য সক্ষম হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। তারপরও তিনি দলের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে। কোনো কারণে সাংসদ বদি ‘মিসিং’ হয়ে গেলে শাহ আলম’র (রাজা শাহ আলম) মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা তুঙ্গে। তাই তিনি মনোনয়ন পেতে দলের বিভিন্ন স্তরে জোর লবিং চালাচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। একই সাথে নির্বাচনী এলাকায়ও যোগাযোগ রক্ষা করছেন তিনি।

দলের মনোনয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা আওমী লীগের সভাপতি এড. সিরাজুল মোস্তফা সিবিএনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যবাহী ও স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী দল। এখানে কর্মী যেমন বেশি নেতাও তেমন বেশি। তাই নেতারা মনোনয়ন চাইতে পারেন। তবে যোগ্য প্রার্থী মনোনিত করবেন দলের হাইকমান্ড। হাইকমান্ড যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষ আমরা কাজ করবো।’


শেয়ার করুন