কক্সবাজারের মেয়ে নাসিমাকে নিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় ঝড়!

500x350_a208675ead365e515c709bb0ba6ee7b6_143802301405সিটিএন ডেস্ক :

কক্সবাজারের মেয়ে নাসিমা আক্তারকে নিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি। ৯ বছর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল কক্সবাজারের মেয়ে নাসিমা আক্তার। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৮ বছরের এই কিশোরী এখন নিজের জগৎ খুঁজে নিয়েছেন ‘সার্ফিং’ খেলায়। সার্ফিংয়ের প্রতি অদম্য ভালবাসা দেখে বিশ্বমিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেন নাসিমা আক্তার।

আর এ ক্ষেত্রে তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে নানা সামাজিক রক্ষণশীলতা ও প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু কোন কিছু দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে। বাংলাদেশে সার্ফিং খেলায় নারীদের পথিকৃত তিনি।

চার বছর আগে মার্কিন সাংবাদিক জয়মাল ইয়োগিসের এক প্রতিবেদনে প্রথম উঠে আসে নাসিমার গল্প। সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়ানোর নেশা তাকে সব বাঁধা ভেঙে এগিয়ে যেতে প্রাণবায়ু জুড়িয়েছে। সেই নয়ে বাড়ি ছাড়া, আজ আঠারোতে এসে কিশোরী নাসিমা এক দূরন্ত সার্ফার। বাংলাদেশে সার্ফিং খেলায় নারীদের পথিকৃত তিনি। বিশ্বমিডিয়াতে হয়েছে নিজের জায়গা। তাকে নিয়ে হয়েছে ডকুমেন্টারি।

কথা হচ্ছে কক্সবাজারের মেয়ে নাসিমা আক্তারের। চার বছর আগে মার্কিন সাংবাদিক জয়মাল ইয়োগিসের এক প্রতিবেদনে প্রথম উঠে আসে নাসিমার গল্প। এরপর তার গল্পে অনুপ্রাণিত হন ক্যালিফোর্নিয়ার প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা হিথার কেসিঞ্জার।

সিদ্ধান্ত নেন নাসিমার গল্প তুলে ধরবেন তার প্রামাণ্যচিত্রে। নাসিমাকে নিয়ে তৈরি প্রামাণ্যচিত্রটির নাম রাখা হয়েছে ‘দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস’। ইতোমধ্যে নাসিমাকে নিয়ে প্রতিবেদন এসেছে বৃটেনের ‘সানডে টাইমস’, দ্য গার্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ার ‘দ্য অস্ট্রেলিয়ান’- এ। এছাড়া নারী বিষয়ক আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ম্যারি ক্লেয়ারেও এসেছে নাসিমার সচিত্র প্রতিবেদন।

আজ নাসিমাকে নিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় মাতামাতি। নাসিমার সার্ফিং দক্ষতা নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। কিন্তু নাসিমার এ অবস্থানে আসার পথটি কিন্তু মোটেই ফুল বিছানো ছিল না। পানিতে নামার জন্য নানা কটূক্তি শুনতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সার্ফিংয়ের প্রতি অদম্য আগ্রহ এগিয়ে নিয়ে গেছে তাকে। হিথার কেসিঞ্জারের প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে নাসিমার সেই লড়াই। ‘দ্য মোস্ট ফিয়ারলেস’- প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এসেছে, মাত্র ৯ বছর বয়সে বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় নাসিমা। এরপর একটি সার্ফ ক্লাবে নিজের পরিবার খুঁজে পান তিনি।

বাংলাদেশ সার্ফ ক্লাব নামের এ সংগঠনটির পৃষ্ঠপোষক একটি মার্কিন ক্রিশ্চিয়ান সংগঠন। নাসিমার পাশাপাশি এখন ক্লাবে আরও অনেক নারী সার্ফার রয়েছেন। তিনিই তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন।

প্রত্যেককেই নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। নাসিমাও মানুষের বিদ্রূপ ও নানা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন। যখনই নাসিমা সমুদ্র সৈকতে গেছেন, আশপাশের লোকজন তাকে ‘বেশ্যা’ বলে কটূক্তি করেছে। নাসিমার পরিবারেরও তার এ সার্ফিং পছন্দ নয়। নাসিমা বলেন, ”আমার স্বামী ও পরিবার সার্ফিং পছন্দ করে না। বাংলাদেশি কোন মেয়ে সার্ফিং করবে এটা তারা পছন্দ করে না। কিন্তু সার্ফিং আমার অসম্ভব ভাল লাগে।

কেসিঞ্জার নাসিমাকে নিয়ে বলেন, নাসিমা একজন ভাল মুসলিম স্ত্রী হতে চায়। সে চায় তার সম্প্রদায়ের সম্মানিত অংশ হতে। কিন্তু এজন্য সার্ফিংয়ের প্রতি তার তীব্র অনুরাগ ছাড়তেও সে সম্পূর্ণ নারাজ। বৃটেনের পত্রিকা ‘দ্য সানডে টাইমস’-এ ‘বাংলাদেশি সার্ফার গার্ল সিঙ্কস মুসলিম ট্যাবুজ’ শিরোনামে নাসিমাকে নিয়ে বলা হয়, নাসিমা বাংলাদেশের একজন সার্ফার। এ কিশোরী বাংলাদেশের রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের প্রচলিত প্রথা ভেঙে মেয়েদের সার্ফিং শেখাচ্ছেন। সমাজের ভয় ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য তাদের অনুপ্রেরণা, উৎসাহ যুগিয়েছেন।

বিভিন্ন সার্ফিং প্রতিযোগিতায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন নিয়মিত। একের পর এক পুরুষ প্রতিযোগীদেরও হারিয়েছেন সার্ফিংয়ে। নাসিমা আক্তার শুধু বাংলাদেশে নারীদের সার্ফিয়ের সূচনার পথিকৃৎ নন, তিনি কক্সবাজারের লাইফসেইভিং অ্যান্ড সার্ফিং ক্লাবে বাংলাদেশের প্রথম নারী লাইফগার্ড বা প্রাণ রক্ষাকারী ব্যক্তির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

এতকিছুর পরও নাসিমার সংগ্রামের পথ যেন শেষ হবার নয়। সমাজের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া নিয়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে নাসিমাকে। ১৬ বছর বয়সে যে তরুণের সঙ্গে তার বিয়ে হয়, তিনিও এটা মেনে নিতে পারেন না। একাধিকবার তিনি নাসিমাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। প্রামাণ্যচিত্রে এ বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।

নানা সার্ফিং প্রতিযোগিতায় জেতা অর্থ দিয়েই চলে নাসিমার জীবিকা। তবে তা বড়ই অপ্রতুল। তাই শামুক-ঝিনুকের খোলস সংগ্রহ করে সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে হয় তাকে। কখনও কখনও সৈকতে উল্টো করে শুইয়ে রাখা নৌকার তলায় ঘুমিয়ে রাত কাটাতে হয়।

কেসিঞ্জার ২ বছর আগে প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের কাজে হাত দেন। সে সময় নাসিমাই ছিল বঙ্গোপসাগরের বুকে দাপিয়ে বেড়ানো একমাত্র কিশোরী। সে সংখ্যা পরে ক্রমেই দীর্ঘায়িত হয়েছে। গত বছর ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সী ৮ জন সার্ফিং ক্লাবে ভর্তি হয়।

এই তরুণী সার্ফারদেরকেও ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের একটি মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে স্থান করে নিয়েছে তাদের মধ্যে একজন। আর এটাকেই সমাজের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ইঙ্গিত বলে মনে করা হচ্ছে।

কেসিঞ্জার বলছিলেন, জীবনে বহু সংগ্রামের পথ পেরিয়েও নাসিমা হাল ছাড়তে আগ্রহী নন এবং তিনি অন্য মেয়েদের জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছেন। যে কোন বিষয়ের পথিকৃৎরা কখনও কখনও নিজের কাজের স্বীকৃতি পান এবং সমাজ তাদের বুঝতে পারে, কখনও হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম তাদের চিনতে পারে।

কেসিঞ্জার বলছিলেন, জীবনে বহু সংগ্রামের পথ পেরিয়েও নাসিমা হাল ছাড়তে আগ্রহী নন এবং তিনি অন্য মেয়েদের জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, যে কোন স্থানের পথিকৃৎদের কথা ভাবুন। কখনও কখনও তারা নিজের কাজের স্বীকৃতি পান এবং সমাজ তাদের বুঝতে পারে, কখনও হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম তাদের চিনতে পারে। তিনি বললেন, নাসিমার গল্প এখনও শেষ হয়নি। ম্যারি ক্লেয়ার ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাসিমা একাধারে একজন পথিকৃত, প্রতিকূলতা উত্তরণকারী আর এখন একজন রোল-মডেল।


শেয়ার করুন