কক্সবাজারের জেলা জজ সাদিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত

y72সূত্রে ইত্তেফাক :

দুর্নীতি, বিচারিক অসততা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মো. সাদিকুল ইসলাম তালুকদারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।

প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের এ সংক্রান্ত জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএ) কমিটি অবিলম্বে তাকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করারও নির্দেশ দিয়েছে।

প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের সদস্য জেলা জজ ড. মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারকে বিভাগীয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করতে বলা হয়েছে।

জজ সাদিকুলের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ– তিনি রামু বৌদ্ধ মন্দির হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার মামলার প্রধান আসামির আতিথেয়তা গ্রহণ করে মাছ শিকার করতে গিয়েছিলেন। মাছ শিকারের পর আসামি তোফায়েল আহমদের আয়োজনে ভুরিভোজেও অংশগ্রহণ করেন তিনি। চট্টগ্রামের জেলা জজ ও দায়রা মো. নুরুল হুদার তদন্ত প্রতিবেদনে এই অভিযোগ প্রমাণিত হয়।

বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি দেখভাল করে জিএ কমিটি। ওই কমিটির প্রধান হলেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। কমিটির অপর তিন সদস্য হলেন হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন, বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। গত ১০ ফেব্রুয়ারি জজ সাদিকুলের বিরুদ্ধে দাখিলকৃত দুটি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জিএ কমিটি ওই নির্দেশ দেয়।

কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মো. সাদিকুলের বিরুদ্ধে কক্সবাজার ছত্রলীগের সাবেক ছাত্র নেতা নুরুল আজিম কনক নামে এক ব্যক্তি প্রধান বিচারপতির কাছে লেখা এক চিঠিতে গুরুতর কিছু অভিযোগ আনেন। প্রধান বিচারপতি এ বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মো. নুরুল হুদাকে তদন্তের দায়িত্ব দেন।

অভিযোগে বলা হয়, গত ১৭ অক্টোবর কক্সবাজার জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান (বরখাস্তকৃত) জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র ক্যাডার এবং বৌদ্ধ মন্দির পোড়ানো মামলার মূল পরিকল্পনাকারী তোফায়েল আহমদের আমন্ত্রণে ভূরিভোজে ও উপজেলা হেড কোয়ার্টার সংলগ্ন লেকে জজ সাদিকুল ইসলাম মাছ ধরতে যান।

গত ১৮ জানুয়ারি কক্সবাজার সার্কিট হাউজের কনফারেন্স রুমে অভিযোগের বিষয়ে অভিযোগকারী কনকের জবানবন্দি ও এর সমর্থনে উপস্থাপিত কয়েকজন সাক্ষীর টেলিফোনে নেয়া বক্তব্য এবং তত্কৃত ধারণকৃত আলোকচিত্র পরীক্ষা, বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে জজ নুরুল হুদা বলেন, আমার অভিমত এই যে, কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মো. সাদিকুল ইসলাম রামু বৌদ্ধ মন্দির ভাংচুর ও পোড়ানো মামলাটির বিচার চলাকালে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের আগের দিন গত ১৭ অক্টোবর জেলার পার্শ্ববর্তী বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদরে মামলাটির আসামি তোফায়েল আহমদের আয়োজনে মাছ ধরতে গিয়েছেন এবং ওই আসামির আয়োজনে আপ্যায়ন তথা ভূরিভোজ গ্রহণ করেছেন। যা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং একজন বিচারকের ক্ষেত্রে গুরুতর অসদাচরণ।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, রামু উপজেলার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, মূর্তি পোড়ানো, ভাংচুর করা, বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ নানা ন্যক্কারজনক ঘটনা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এ ঘটনার কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুল বার্তা প্রেরিত হয়েছে। এটি আমাদের বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

ফলে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। মামলাটির বিচার চলাকালে সাক্ষীগণ প্রসিকিউশনের মামলার সমর্থনে বক্তব্য না দেয়ায় এইরূপ চাঞ্চল্যকর একটি মামলার বিচার চলাকালে মাঝপথে অপমৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এটি খুবই দুঃখজনক, বেদনাদায়ক ও অনভিপ্রেত।

সাদিকুলের বিরুদ্ধে দাখিলকৃত অপর তদন্ত প্রতিবেদনে নূরুল হুদা বলেন, কক্সবাজারের জেলা জজ হিসেবে যোগদানের পর থেকে সাদিকুল ইসলাম তার নিজের ও অন্যান্য আদালতের হাজার হাজার পিস ইয়াবা সংক্রান্ত ফৌজদারি বিবিধ মামলা, স্পর্শকাতর খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এবং এসিড মামলার আসামিদের অর্থের বিনিময়ে জামিন দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

তদন্তকালে এসব অভিযোগের বিষয়ে ওই জেলা জজ আদালতের কর্মচারীগণ আমার কাছে সাক্ষাত্কার প্রদান কালে সুনির্দিষ্টভাবে কোন বিষয় উল্লেখ না করলেও কেউ কেউ অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্তভাবে কিছু মামলার নম্বর আমাকে দেন। যার নম্বরগুলো হচ্ছে, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল মামলা নং-২০৪৪/২০১৫ (৫০০ পিস ইয়াবাসহ হাতেনাতে ধৃত) , ৯২/২০১৫ (অস্ত্র ও ইয়াবা মামলা), ৩২৩/২০০৭ (হত্যা মামলা), ১৯২০/২০১৫ (৮৯ হাজার পিস ইয়াবার মামলা), ২০১/২০০৮ (হত্যা মামলা), ফৌজদারি মিস মামলা ১৭৬৮/২০১৫ (১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ হাতেনাতে ধৃত মামলা) ও ১৩২৫/২০১৫ (এক লক্ষ পিস ইয়াবা মামলা)।

পরে ওইসব মামলার নথিসমূহ পরীক্ষা করে জেলা জজ নুরুল হুদা তার তদন্ত প্রতিবেদনে বলেন, ওইসব মামলার সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র, এজাহার এবং জামিনের আদেশ পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয়েছে যে, প্রদত্ত জামিনগুলি বিচারিক অসততা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিফলন। যা সুনির্দিষ্টভাবে দুর্নীতির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে। এমতাবস্থায় সাদিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের কর্মচারীগণ কর্তৃক আনীত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল মামলা নম্বর ২০১ এর নথি পর্যালোচনা করে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই মামলাটিতে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারাসহ অন্যান্য ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। ২০০১ সালের ২৫ জুলাই এই হত্যা মামলাটি দায়ের হয়। বাবুল মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।

এই আসামি দীর্ঘ ১৪ বছর পলাতক থেকে গত বছরের ১৩ জানুয়ারি ওই আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান। কেন জামিন দেয়া হলো আদেশে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। একজন পলাতক আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী হয় না। তাকে অবশ্যই হাজতবাসে যেতে হবে।

৩২৩ নম্বর মামলার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটিও একটি হত্যা মামলা। ২০০৬ সালের ২৯ এপ্রিল মামলাটি দায়ের করা হয়। এই মামলার এক নম্বর আসামি আবদুস সালাম নয় বছর পলাতক থেকে গত ২৬ নভেম্বর দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান।

জামিন আদেশে এমন কতিপয় বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলো বাস্তবে ওই মুহূর্তে বিবেচ্য ছিল না উল্লেখ করে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছেন, এটি দৃষ্টিকটু বিচারিক অসততা এবং প্রচলিত আইনের প্রতি অবজ্ঞা।

ফৌজদারি বিবিধ মামলা নং ১৩২৫ উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এক লাখ পিস ইয়াবা দখলে রাখার অভিযোগে মামলার দুই নম্বর আসামি সামশুল আলম শামীম গত ২৫ এপ্রিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। কিন্তু এক মাসের মধ্যে তিনি জেলা ও দায়রা আদালত থেকে জামিন পান। এত দ্রুততম সময়ের মধ্যে জামিন পাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা নয়।

এই জামিন দেয়ার কারণে আদালত সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা যাবে যে গ্রেফতার হলেও বেশিদিন হাজতে থাকতে হবে না। ফলে অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনে উত্সাহিত হবেন। এটিও সহজে অনুমেয় যে এক্ষেত্রেও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়ে থাকতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশেষ ট্রাইব্যুনালের ২০৪৪ নম্বর মামলার বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ১ ডিসেম্বর তারিখের জজ সাদিকুল যুগ্ম দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের একটি মামলার নথি তলব করেন। নথি আসার পর ইয়াবা মামলার কারাবন্দি আসামি ঝুমুর সিকদারের জামিন মঞ্জুর করা হয়।
নথি উপস্থাপনের আবেদনের ভিত্তিতে আসামিকে জামিন দিয়ে পুনরায় ওই আদালতে নথি ফেরত পাঠানোর কাজটি সম্পূর্ণই বেআইনি ও অসত্ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জজ সাদিকুল অবৈধ সুবিধা লাভ করার উদ্দেশ্যেই এই বেআইনি কাজটি করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মো. নুরুল হুদা।


শেয়ার করুন