ঈদের দিনে সীমান্তে কাঁদছে মানবতা, মোট ৪৯ রোহিঙ্গার লাশ

নিজস্ব প্রতিনিধি :

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে হত্যা-নির্যাতনে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বৌদ্ধদের নির্যাতনের স্টিমরোলার যেন কোনো মতেই থামছে না। মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময় নৌকাডুবিতে নিহত রোহিঙ্গাদের লাশের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত মোট ২৬ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে গত কয়েক দিনে নৌপথে আসার সময় নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাল ৪৯ জন। মৃত্যুর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের ঢল।

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা স্বজন হারানো এসব রোহিঙ্গাদের আর্তচিৎকারে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। ফলে ঈদের দিনেও দেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে কাঁদছে মানবতা।

পুলিশ সূত্র জানায়, শুক্রবার স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় টেকনাফ পুলিশ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কানজরপাড়া, খারাংখালী, শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং ও খানকারপাড়া থেকে ২৬ লাশ উদ্ধার করে। এর আগে বৃহস্পতিবার শাহপরীর দ্বীপে সাগর উপকূল থেকে ১৯ রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। আর মঙ্গলবার নাফ নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল ৪ জনের মৃতদেহ। সবমিলে গত কয়েকদিনে ৪৯জনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

অন্যদিকে প্রতিদিনই বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে শত শত রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা গত ২৪ আগস্ট থেকে পরবর্তী ৬ দিনে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের কথা জানিয়েছিল। এ পর্যন্ত কতজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ করেছে, তার তথ্য সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও প্রশাসন জানাতে পারেনি। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা অন্তত ৪০ হাজার। এর আগের ৮ দিনে এসেছে আরো ৪০ হাজার।

টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও রোহিঙ্গারা দলে দলে ঢুকে পড়ছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে। নাফ নদীতে নৌকাডুবির সত্যতা নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে নাফ নদী থেকে ১৮ রোহিঙ্গার লাশ পাওয়া গেছে। এগুলো মায়ানমার থেকে ভেসে আসে বলে খবর পাওয়া গেছে।

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী বলেন, শুক্রবার ভোরে ইউনিয়নের উনচিপ্রাং ও লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে। তাদের অনেকে ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মইন উদ্দিন খান বলেন, গত দুই দিনে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রোহিঙ্গাদের আটক করে এক সীমান্ত দিয়ে ফেরত পাঠালে অন্য সীমান্ত দিয়ে তারা আবার ঢুকছে। সড়ক, পথঘাট, অলিগলি সবখানে এখন রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। তিনি জানান, আজ উদ্ধার করা ১৮ মৃতদেহের মধ্যে ১১ জন পুরুষ, পাঁচজন নারী ও দুটি শিশু।

পালিয়ে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেন, ঈদের দিন রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ‘গণহত্যা’ চালানো হবে—এমন গুজবের পর রোহিঙ্গারা দলে দলে সীমান্তে জড়ো হচ্ছেন।

শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে দেখা গেছে, অসংখ্য রোহিঙ্গা নৌকা থেকে নেমে টেকনাফ শহরের দিকে রওনা দিয়েছেন। কেউ রিকশা, আবার কেউ ইজিবাইকে উঠেছেন। সেখানে কথা হয় আমেনা খাতুন (৬০) নামের এক নারীর সঙ্গে। তার ভাষ্য, রাখাইন রাজ্যে গত দুই দিন ধরে সেনা ও পুলিশের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালাচ্ছেন। আজ ভোরে তারা রাখাইন রাজ্যের ফাদনচা গ্রাম থেকে নৌকা নিয়ে এখানে নেমেছেন। এখন টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গাশিবিরে যাচ্ছেন। সেখানে তাদের আত্মীয়স্বজন আছেন।

এছাড়াও গত কয়েকদিনে টেকনাফের নয়াপাড়া, সাবরাং, নাইটংপাড়া, জাদিমুরা, হ্নীলা, হোয়াইক্যং, উখিয়ার বালুখালী, রহমতেরবিল, ধামনখালী, আঞ্জুমানপাড়া, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, তুমব্রু, চাকঢালাসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছেই। এত দিন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড ও পুলিশের কড়াকড়ির কারণে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেনি। তবে বৃহস্পতিবার থেকে রোহিঙ্গা স্রোত আটকানো যাচ্ছে না।

উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের বলেন, রাখাইন রাজ্যে দমন-পীড়নের মুখে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি হিন্দুরাও বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন। উখিয়ার একটি পরিত্যক্ত মুরগির খামারে আশ্রয় নিয়েছে রাখাইন রাজ্যের ফবিরাবাজার থেকে পালিয়ে আসা ৪১২ জন হিন্দু নারী, পুরুষ ও শিশু।


শেয়ার করুন