"শেখ জায়েদ গ্রান্ড মসজিদ"

আরব আমীরাতে ইসলামের এক অপরূপ নিদর্শন

Untitled-1

আরিফ সিকদার বাপ্পী, দুবাই সংযুক্ত আরব আমিরাত:

সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবীতে অবস্থিত এই মসজিদ টি সারা পৃথিবীতে ৮ম এবং নিজ দেশে ১ম । শেখ জায়িদ, কে আরব আমিরাতের জাতির পিতা বলা হয়, তার নেত্রিত্বের হাত দিয়েই এই দেশে প্রতিষ্ঠা হয়, তাই এই মসজিদের নামকরন তার নামে করা হয়। এই মসজিদটিকে ২০০৭ সালের রমজান মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।এই মসজিদের ডানপাশে রয়েছে শেখ জায়িদ এর সমাধি, সেখানে প্রতিনিয়ত কুরআন তেলাওয়াত চলতে থাকে। কেউ যদি ক্যামের‌্যা নিয়ে যান তাহলে উক্ত মসজিদের সব কিছুই আপনি বিনা বাধায় ক্যামেরাবন্ধী করতে পারবেন, কিন্তু সমাধিস্থ কোন ছবি আপনাকে উঠাতে দিবে না। তাছাড়া বির্ধমী যে কেই এই মসজিদ দেখার জন্য প্রবেশ করতে পারে, শুধু মাত্র শুক্রবার ছাড়া, এছাড়াও মহিলা হলে কালো বোরকা পরিধান করে ভিতরে প্রবেশ এবং অমুসলিম নারী পুরুষ যেই হোক না কেন পবিত্র গ্রস্থ কুরআন কোনভাবেই স্পর্শ করতে পারবে না।

শেখ জায়িদ মসজিদের পুরো নকসায় আরব, মুঘল এবং মুনরিস স্থাপত্যের একটি সংমিশ্রন দেখা যায়্।মসজিদটি মুঘল এবং মুনরিস স্থাপত্যের দিকে অনুপ্রানিত হয়ে করা হয়েছে, যা লাহোর এর বাদশাহী মসজিদ এবং কাসাব্লাংকার হাসান টু মসজিদের সরাসরি ছায়া পাওয়া যায়। গম্বুজের নকসা এবং ফ্লোরের নকসা প্রনয়নে বাদশাহী মসজিদ হতে অনুপ্রানিত হয়ে করা হয়েছে এবং স্থাপত্যের কাঠামোগুলোর নকসা প্রনয়নে অনুপ্রানিত করা হয়েছে মুঘল এবং মুনরিস জিজাইন হতে। এর খিলান গুলো দেখতে মুনরিস নকসার মতো এবং এর মিনারগুলোর নকসা করা হয়েছে আরবের ঐতিহ্যকে সামনে রেখে। প্রধান নামাজকক্ষের দেওয়ালে রয়েছে আল্লাহ গুনবাচক ৯৯টি নাম এবং এর নকসাগুলোতে বিশেষ একধরনের লাইটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, যা দেখে মনে হতে পারে প্রতিটি নকসার লাইনের সাথে বুঝি আলো জালানো আছে। পুরো মসজিদের আগা হতো গোড়া পর্যন্ত কারুকাজ খচিত নকসা করা।

এই মসজিদে একসাথে ৪০ হাজার সুসল্লির নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রধান নামাজ কক্ষে এ ৯ হাজার এবং এর সাথে অবস্থিত দুটো নামাজ কক্ষের প্রতিটিতে ১৫০০ করে মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পাবরে, যার মধ্যে উক্ত কক্ষ দুটি শুধুমাত্র মহিলাদের নামাজের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। মসজিদের চারপাশের রয়েছে ৪টি মিনার, যেটির উচ্চতা হলো ১১৫ মিটার বা ৩৭৭ ফিট। প্রধান বিল্ডিং এবং উঠানের সিমানায় চারপাশে রয়েছে ৫৭টি ছোটবড় গুম্বজ। গুম্বজগুলো উপর মাবের্ল পাথর বসানো এবং এর নকসাতে ব্যবহার করা হয়েছে এই মার্বেল পাথর। এর উঠানের আয়াতন হলো ১৭০০০ ঘন মিটার বা ১৮০০০০ ঘন ফিট। এর উঠানে প্রধান যে বৈশিষ্টয হলো পুরো উঠানটা মার্বেল পাথার দিয়ে ঢাকা এর মূল নামাজের বিল্ডিং এর দিকে ফুলেল রঙ্গিন নকসা করা, তবে সাবধান গরমের দিনে সাদা মার্বেল পাথরের উপর খালি পায়ে নির্ভয়ে পা ফেলতে পারেন।

বিশ্বের সবচেয়ে দামী এবং সর্ববৃহ‍ত কার্পেট এইখানে ব্যবহার করা হয়েছে, যা কার্পেট তৈরির বিশ্বখ্যাত দেশ, ইরান হতে আল খালিকি নামক ডিজাইনারে ডিজাইনকৃত। এই কার্পেট এর আয়াতন ৫৬২৭ ঘন মিটার বা ৬০৫৭০ ঘন ফিট, যা তৈরি করতে ১২০০ তাতি, ২০ জন টেকনিশযান এবং ৩০ জন্য শ্রমিক এর শ্রম ব্যায় করতে হয়েছে। কার্পেটটির ওজন মোট ওজন হলো ৪৭ টন, এর মধ্যে ৩৫ টন উল এবং ১২ টন কটন ব্যবহার করা হয়েছ। মোট কটন ব্যবহার করা হয়েছে ২২৬৮০০০০০০টি ।

এই মসজিদে জার্মানী হতে আআমদানীকৃত যে ঝাড়বাতিগুলো ব্যবহার করা হয়েছে , তা আয়াতনে বিশ্বের আর কোথাও নেই। এর ডায়ামিটার হলো ১০ মিটার বা ৩৩ ফিট এবং এর উচ্চতা হলো ১৫ মিটার বা ৪৯ ফিট।

শেখ জায়েদ মসজিদের প্রায় চারদিক ঘিরে রেখেছে স্বচ্ছ টলটলে জলের চৌবাচ্চা। রাতের বেলায় বিশেষভাবে আলোকিত এই মসজিদ চত্বরে চলে আলোর খেলা। দিন আর রাতে জলের চৌবাচ্চায় ভবনের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়ে তৈরি করে দারুণ এক জলছবির খেলা। বিষয়টা এমনই যে, বছরজুড়ে মসজিদ দেখতে আসা দর্শনার্থীদের তোলা এসব চৌবাচ্চা আর মসজিদ চত্বরের ছবি নিয়ে আয়োজন করা হয় আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার। সেরা ছবিগুলো প্রদর্শিত হয় এমিরেটস প্যালেস হোটেলের প্রধান লবির গ্যালারিতে এবং সেগুলো ছাপাও হয় ‘স্পেসেস অব লাইট’ নামে।

শেখ জায়েদ মসজিদের সবার জন্য ‘দ্বার খোলা রাখার নীতি’ মনে করিয়ে দেয় ইসলামের স্বর্ণযুগের কথা, যখন মসজিদগুলোই ছিল মানুষের মিলনমেলার কেন্দ্র। প্রতিবছর ১০ লাখেরও বেশি দর্শনার্থী আসেন এই মসজিদ দেখতে।এখানে সবাইকে স্বাগত জানানো হয়, তিনি ইহুদি, খ্রিষ্টান বা যে কেউ হন না কেন। এর এটাই বিশেষত্ব। শেখ জায়েদের ভাবনায় কেবল মুসলিমদের জন্য একটা মসজিদ ছিল না, বরং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটা পাটাতন গড়ে তোলার চিন্তা ছিল। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধান রূপকার ও দীর্ঘ সময় ধরে দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের নামেই মসজিদটির নাম রাখা হয়েছে শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মস্ক।

আরবের বেদুইন গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাফল্যের মধ্য দিয়ে চল্লিশের দশকে পাদপ্রদীপে আসেন শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান। ১৯৬৬ সালে আবুধাবির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হন তিনি। ১৯৭১ সালে তাঁর উদ্যোগে দুবাই আমিরাতের সঙ্গে আবুধাবির ফেডারেশন গঠনের মধ্য দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত গঠনের পথ সুগম হয়। প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনিই সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্ব দেন। আবুধাবির বিপুল তেলের রাজস্ব কাজে লাগিয়ে দেশটির আধুনিকায়ন এবং সেখানে বিশ্বমানের সব স্থাপত্য নির্মিত হয় তাঁর আমলেই। এই গ্র্যান্ড মস্ক বা বড় মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার তিন বছর আগে ২০০৪ সালে শেখ জায়েদ মারা যান। এই মসজিদ প্রাঙ্গণের উত্তর দিকে সমাধিসৌধ বানিয়ে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

লেখক:- আরিফ সিকদার বাপ্পী

সহকারী প্রকৌশলী,

দুবাই সিটি পৌরসভা (Dubai Municipality)

দুবাইসংযুক্ত আরব আমিরাত


শেয়ার করুন