অস্ত্রের প্রভাবে হিংস্র ছাত্র রাজনীতি: হাই কোর্ট

কুপিয়ে জখমের পর রক্তাক্ত বিশ্বজিৎ দাসকে ধাওয়া করে পেটানো হচ্ছে, যাতে মৃত্যু ঘটে তার

বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে হতাশা ঝরেছে উচ্চ আদালতের কণ্ঠে।

রোববার দেওয়া রায়ে বলা হয়েছে, ছাত্র রাজনীতি অতীতের গৌরব তো ধরে রাখতে পারছেই না, বরং অস্ত্রের প্রভাবে কখনও কখনও হিংস্র হয়ে উঠেছে।

আলোচিত হত্যাকাণ্ডের এই রায়দানকারী বিচারকদের একজন রুহুল কুদ্দুস বাবু ছাত্র আন্দোলনের নেতা ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন তিনি, ছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি।

বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের আসামিদের সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজনৈতিক হানাহানির মধ্যে পড়ে মারা গিয়েছিলেন নিরীহ দরজি দোকানি বিশ্বজিৎ। বিএনপি জোটের অবরোধ ছিল সেদিন, তার বিরোধিতায় রাজপথে নেমেছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের কর্মীরা।

রায়ে বলা হয়েছে, “বিশ্বজিৎ কোনো রাজনৈতিক দল করত না। সে ছিল নিরস্ত্র ও নিরীহ। এই হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত না হলেও হামলাকারীদের উন্মত্ত আক্রমণেই বিশ্বজিতের মৃত্যু হয়েছে।”

কোনো রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ না করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “ছাত্র রাজনীতি তার গৌরব ধরে রাখতে পারছে না। অস্ত্র এবং মাদক বর্তমান ছাত্র রাজনীতিতে প্রকাশ্য বিষয়।

“ফলে ছাত্র রাজনীতির নামে তারা চাঁদাবাজি, হত্যা, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়। মাদক এবং অস্ত্রের বিরূপ প্রভাবে কোনো কোনো সময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা হিংস্র, ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।”

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের উজ্জ্বল ভূমিকা থাকলেও এর সাম্প্রতিক প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ হচ্ছে নানা মহল থেকে।

রায়ে বলা হয়, “এমন একটা সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে যে, মিছিলে লোক বাড়ানোর জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয়। অনেক সময় আবাসিক শিক্ষার্থীরা হলের সিট ধরে রাখতে মিছিলে বা কর্মসূচিতে আসতে বাধ্য হয়।

“যদি সাধারণ শিক্ষার্থীরা দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করে তবে তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এরকম ঘটনাও দেখা গেছে যে, পরীক্ষার হলে নকল করতে না দেওয়ায় দায়িত্বরত শিক্ষককে মারধর করা হয়েছে। এটি ছাত্র রাজনীতির জন্য অশনি সঙ্কেত। কারণ তারাই ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেবে।”

হাই কোর্ট হতাশা প্রকাশ করেছে বর্তমান ছাত্র রাজনীতি নিয়ে
হাই কোর্ট হতাশা প্রকাশ করেছে বর্তমান ছাত্র রাজনীতি নিয়ে

ছাত্রদের বিপথে পরিচালনার জন্য মূল রাজনৈতিক দলের নেতাদের সমালোচনাও রয়েছে, যার প্রতিফলনও ঘটেছে হাই কোর্টের রায়ে।

পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “কিছু রাজনৈতিক নেতা এ ব্যাপারে প্রণোদনাও দিয়ে থাকে। তারা মনে করে এতে তাদের রাজনৈতিক পরিচিতি আরও সমৃদ্ধ হবে।”

বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে নিম্ন আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, “এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি হরতাল অবরোধের ক্ষেত্রে আহ্বানকারী পক্ষ ও বিরোধীপক্ষকে গণতন্ত্র রক্ষা ও আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার জন্য গভীর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়া আশঙ্কা, জনসাধারণের শান্তিভঙ্গ বা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা, সম্পত্তির ক্ষতিসাধন না হয়।”

রায়ের পর্যবেক্ষণে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছে হাই কোর্ট।

আদালত বলেছে, সাক্ষ্য এবং ভিডিও চিত্রে বিশ্বজিতের শরীরে একাধিক আঘাতের উল্লেখ থাকলেও মামলার সুরতহাল, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে একটি মাত্র আঘাতের কথা এসেছে। তবে প্রতিবেদন দুটিতে আঘাতের স্থান নিয়ে গড়মিল রয়েছ।

“একটি অস্বচ্ছ তদন্ত সমাজকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলতে পারে এবং সমাজে এ ধরনের অপরাধ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিতে পারে। ফলে ন্যায়বিচারের স্বার্থেই এ দুটি (সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত) বিষয়ে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।”

সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন যারা তৈরি করেছেন, তাদের অবহেলা বা গাফিলতি অনুসন্ধানের দাবি রাখে বলে মন্তব্য এসেছে আদালতের কাছ থেকে।

 


শেয়ার করুন