‘নুন’ খাওয়া দেশের জন্য ভালো কিছু করতে চান শরৎ দাশ

‘অবৈধ অভিবাসন’ বলে কোন শব্দ আইওএমের অভিধানে নেই

Cox'sBazar Picture 14.09.2015 (IOM)

আনছার হোসেন

নির্বাহী সম্পাদক ও বার্তা প্রধান

দৈনিক সৈকত

‘আদিমকাল থেকেই অভিবাসন হয়ে আসছে। এখনও চলছে, আগামিতেও চলবে! এই অভিবাসন থেকে কিভাবে একটি দেশ সুবিধাভোগ করতে পারবে তা নির্ভর করছে অভিবাসন প্রক্রিয়াটাকে কিভাবে ম্যানেজ করা হচ্ছে তার উপর। ঠিক মতো ম্যানেজ করতে না পারলে অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসনও হবে, সাথে মানবপাচারও হবে।’
এভাবেই সারাবিশ্বের অভিবাসন নিয়ে নিজের অভিমত তুলে ধরেছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বাংলাদেশস্থ ঢাকা মিশনের প্রধান শরৎ দাশ।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮৭ লাখ অভিবাসী হয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। প্রতিবছর অন্তত ৫ লাখ মানুষ অভিবাসন করছেন। তারা বিদেশের চাকুরি ও ব্যবসা করে বাংলাদেশের জিডিপি সমৃদ্ধ করছেন।’
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার অভিধানে ‘অবৈধ অভিবাসন’ নামে কোন শব্দ নেই জানিয়ে বলেন, ‘সারাবিশ্বে দুইভাবে অভিবাসন হয়ে আসছে। একটি ‘নিয়মিত’ অভিবাসন, অন্যটি ‘অনিয়মিত’ অভিবাসন! ‘অনিয়মিত’ অভিবাসনে দেশের আইনের আওতায় অভিবাসন না হওয়ায় অভিবাসীরা প্রতারিত হচ্ছেন। বিদেশের মাটিতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানি, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।’
প্রতিবেশি দেশ ভারতের উড়িষ্যায় জন্মগ্রহণকারি এই ভারতীয় মনে করেন, ‘অনিয়মিত অভিবাসন থেকে উত্তরণ করতে গেলে আমাদের অভিবাসন বিষয়টা নিয়ে নিয়মিত ‘চর্চা’ করতে হবে। মিডিয়া কর্মীদেরও এই বিষয়ে নিয়মিত চর্চা থাকা দরকার।’
আইওএমের ঢাকা মিশনের প্রধান হিসেবে টানা তিনবছর দায়িত্ব পালনকালের নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে শরৎ দাশ বলেন, ‘বাংলাদেশের মিডিয়া কর্মীরা অভিবাসন নিয়ে কোন একটি ঘটনা পেলে দুয়েকদিন ব্রেকিং নিউজ করেই দায়িত্ব শেষ করেন। ওই ঘটনার আর কোন ফলোআপ পাওয়া যায় না। অথচ বিদেশ ফিরে আসা অভিবাসীরা দেশে ফিরে এসে কী অবস্থায় আছেন, কোন হুমকি ধমকির শিকার হচ্ছেন কিনা, দালালরা কী করছেন এসব নিয়ে ভালো ফলোআপ প্রতিবেদন একজন পাঠক হিসেবে আমি আশা করি।’
তিনি তাঁর ছোটবেলায় বাবার দেয়া উপদেশের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘তুমি যার নুন খাবে তার গুণগান তোমাকে গাইতে হবে। কর্মজীবনে এসে বাবার সেই পরামর্শ উপলব্ধি করে আমি যে দেশেই যাই সে দেশের ভাষা শেখা, সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।’
তিনি রোববার সন্ধ্যায় কক্সবাজার শহরের একটি অভিজাত হোটেলে ‘মিডিয়া ডায়ালগ ২০১৫’ অনুষ্টানে এসব মতামত তুলে ধরেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) প্রতিষ্টা বার্ষিকী উপলক্ষে কক্সবাজারে কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য এই আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল।
আর এই অনুষ্টানে দীর্ঘ প্রায় দুই ঘন্টা ধরে উড়িষ্যার অধিবাসী হয়েও শরৎ দাশ বাংলা ভাষায় কথা বলেন!
তিনি বলেন, ‘১৯৫১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা প্রতিষ্টা হয়েছিল। শুরুতে এটির নাম ছিল আইইসিএম। বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশ আইওএমের সদস্যভূক্ত। প্রায় ৯ হাজার কর্মী এই সংস্থায় কাজ করেন।’
‘আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) কোন এনজিও নয়’ জানিয়ে শরৎ দাশ বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন আইওএম অন্য দশটি এনজিওর মতোই একটি এনজিও। মিডিয়া কর্মীরাও আইওএমকে চিনতে ভুল করেন।’
তিনি বলেন, ‘আইওএম মূলত আন্তঃসরকার সংস্থা। সদস্যভূক্ত দেশগুলোর সরকারই আমাদের পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা মূলত অভিবাসন সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে দেশগুলোর সমন্বয় করে থাকি।’
শরৎ দাশ দাবি করেন, ‘জোর করে কোন অভিবাসীকে আমরা ফিরিয়ে আনি না। কোন অভিবাসী যদি মনে করেন, তিনি অভিবাসন হওয়া দেশটিতে আর কোন সুবিধা করতে পারবেন না। তিনি অবৈধ ভাবে থাকার নানা বিড়ম্বনার শিকার হবেন। ওই অভিবাসী যদি নিজে ইচ্ছে করেন, তিনি নিজ দেশে ফিরে আসবেন তখন অভিবাসী সংশ্লিষ্ট দেশে নিজ দেশের মিশনে আবেদন করবেন। দেশটির মিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গুলো আইওএমকে সহায়তার প্রস্তাব দিলে তখনই কেবল এই সংস্থাটি ওই সকল অভিবাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় সমন্বয় করেন।’
তিনি জানান, বাংলাদেশ ১৯৯১ সালে আইওএমের সদস্য হয়েছে। সদস্য হওয়ার পর থেকে আইওএমের ঢাকা মিশন নানা ক্রাইসিসে কাজ করেছে। লিবিয়া ক্রাইসিস, ইয়েমেন ক্রাইসিসসহ নানা দুঃসময়ে আটকেপড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেছে আইওএম।’
প্রতিবছর ৮০০ থেকে এক হাজার অভিবাসীকে ফিরিয়ে আনতে সহায়তার কথা জানিয়ে বাংলাদেশের আইওএম প্রধান বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে অনিয়মিত অভিবাসন প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে দুই হাজার ১২ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আরও অন্তত ৭০০ অভিবাসী ফেরত আসার প্রক্রিয়ায় আছেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে আইওএমের এই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশে আছেন। এটি ‘দীর্ঘায়িত অভিবাসন’। এই অভিবাসন প্রক্রিয়ায় দুই দেশ সম্মত হলেই কেবলই তাদের ফিরিয়ে নেয়া যাবে। তাছাড়াও আইওএম শুধুমাত্র স্বেচ্ছায় দেশে ফিরতে ইচ্ছুকদের আইনি ও সংশ্লিষ্ট দেশের সমন্বয়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনে কিংবা ফিরিয়ে নিয়ে যায়।’
তিনি মনে করেন, ‘রোহিঙ্গারা নিয়মিত ও অনিয়মিত কোন ধরণের অভিবাসনের পর্যায়েই পড়ে না। তারা নিজের ইচ্ছায় এদেশে আসেননি। ওই দেশের (মিয়ানমার) একটি পরিস্থিতিতে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।’
তবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশ সম্মত হয়ে সহায়তা চাইলে আইওএম সহায়তা করবে বলেও জানান আরও এক বছর আইওএমের ঢাকা মিশনের দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তা।
তিনি জানান, এতোদিন বাংলাদেশ থেকে কত মানুষ অভিবাসী হয়ে বিদেশে গেলেন সেই ডাটাই কেবল সরকারের কাছে ছিল। কিন্তু আইওএমের সহায়তায় কত অভিবাসী ফিরে এলেন সেই ডাটাও এখন সরকারের হাতে রয়েছে।
আগামি একবছর আইওএমের ঢাকা মিশনের প্রধান থাকাকালিন বাংলাদেশের জন্য তিনি কী করতে চান এমন এক প্রশ্নের জবাবে শরৎ দাশ বলেন, ‘বাংলাদেশে মাইগ্রেশন গভর্নেন্স কিভাবে উন্নতি করা যায় তা নিয়ে আমি করে যাচ্ছি। তাছাড়াও অভিবাসীদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় অভিবাসন আইনের ‘চ্যাপ্টার ১১৮’ কিভাবে দ্রুত ও গ্রহণযোগ্য ভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তার উপর আমার নজর থাকছে।’
শরৎ দাশ ভারতীয় নাগরিক হলেও তিনি যে দেশের (বাংলাদেশ) নুন খাচ্ছেন সেই দেশের জন্য কিছু একটা করতে চান! তিনি বাংলাদেশের সাগরপথে ‘অনিয়মিত’ অভিবাসনকে নিয়ে কাজ করে ভালো কিছু একটা করে যেতে চান।
ওই সময় ‘মিডিয়া ডায়ালগে আরও উপস্থিত ছিলেন আইওএমের কক্সবাজার উপ-কার্যালয়ের প্রধান সংযুক্তা সাহানী ও জাতীয় কর্মসূচি কর্মকর্তা আসিফ মুনীর।
সংযুক্তা সাহানীও চান বাংলাদেশের মানুষ অভিবাসন নিয়ে চিন্তা করুন। কক্সবাজারে কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য অভিবাসন সংক্রান্ত কর্মশালা আয়োজনেরও চিন্তা করছেন বলে জানান তিনি।


শেয়ার করুন