অপেক্ষা

shajahanমূল: সন্তি কৃষ্ণমূর্তি

অনুবাদ: মোহাম্মদ শাহজাহান

[ সন্তি কৃষ্ণমূর্তি ভারতীয় কথা-সাহিত্যিক। তেলুগু ভাষার খ্যাতিমান লেখক তিনি। এখানে অনুদিত তাঁর ছোটগল্পটিতে ভারতীয় তথা উপমহাদেশের নির্বাচন-ব্যবস্থায় কালো টাকার ছড়াছড়ির বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে।]

– আমার জন্যে কিছু এসেছে?

সে জিজ্ঞেস করে। প্রশ্নটিতে দ্বিধা, লজ্জা,হতাশা ও আশার প্রতিধ্বনি টের পায় চন্দ্রকুমার।

– না। চন্দ্রকুমার বলে।

হতাশ মনে ফিরতি পথ ধরে সে। চন্দ্রকুমার বিস্মিতনেত্রে তাকায় তার দিকে।

সে যে ঠিক কীসের জন্যে অধীর অপেক্ষায় আছে, চন্দ্রকুমার ভেবে পায় না। চন্দ্রকুমার পোষ্টমাস্টার হয়ে এই গ্রামে এসেছে দু’মাস আগে। এর মধ্যে প্রতিদিন ডাকঘরে এসে একই প্রশ্ন করে করে হতাশ মনে ফিরে গেছে সে। ব্যাপারটিতে অবাক হয় চন্দ্রকুমার। শাখা ডাকঘর হওয়ায় কোন ডাক পিয়ন নেই এখানে। ফলে চিঠিপত্র বাছাই ও বিলি- চন্দ্রকুমারকেই করতে হয় সবকিছু। তবে গ্রামের লোকজন ডাকঘরে এসেই চিঠিপত্র নিয়ে যান বলে খুব একটা বেগ পেতে হয় না তার। অবশ্য, কালেভদ্রে দুয়েকটি চিঠি রয়ে গেলে সেগুলো সুবিধাজনক সময়ে নিজে গিয়ে বিলি করে আসে সে। তাছাড়া, মাঝেমধ্যে চিঠিপত্র পড়ে শুনিয়ে, ব্যাখ্যা করে কিংবা লিখে দিয়েও গ্রামবাসীদের সাহায্য করে সে। গ্রামের লোকজনকে সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করে সে। নির্দ্বিধায়। প্রত্যেকের মন যুগিয়ে কথা বলতে জানে সে। খবরের কাগজ পড়ে গ্রামবাসীদের নিকট ব্যাখ্যা করাও নিত্যদিনের সান্ধ্যকালীন কাজ তার। অন্য সময় চুপচাপ থাকতেই ভালোবাসে সে। পোষ্টমাস্টার পদে চাকুরি করে পনেরো রুপি মাইনে পায়। একজন ডাক হরকরার মাইনেও পোষ্টমাস্টারের চেয়ে বেশি। তবু চাকুরিটা চন্দ্রকুমারের পছন্দই বলতে হবে।সে চলে যাবার পর ওই দিনের ডাকে আসা পত্রিকাটি পড়ার জন্যে হাতে তুলে নেয় চন্দ্রকুমার। কিন্তু বারবার মহিলাটার কথা মনে পড়ছে বলে

মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারে না।

সে প্রতিদিন একই সময়ে এসে জানতে চায়:

-আমার জন্যে কিছু এসেছে—-?

– না। চন্দ্রকুমারও প্রতিদিন জবাবে বলেন। না-সূচক উত্তর পেয়ে সেও প্রস্থান করে। হায়! এমন কী আছে যার জন্যে এভাবে অপেক্ষা করে চলেছে সে? কিছুই ভেবে পায় না চন্দ্রকুমার। কিন্তু কোন সদুত্তর খুঁজে পায় না। অবশ্য,কখনও তার কাছে জানতে চায়নি সে। কারণ, মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জিত অনুভব করে সে; এমনকি দ্বিধাগ্রস্থও বোধ করে। ভয়ও লাগে। মারধরের বা গালিগালাজের শিকার হবার ভয় নয়। বরং অকারণেই ভয় লাগে তার। সে বয়সে তার চেয়ে খানিকটা বড় হবে। দেখতেও সুন্দরী। কেমন যেনো অদ্ভূদ এক ভালো লাগা ঘিরে আছে তাকে। তবে “দীর্ঘ অপেক্ষা”র বিষয়টিই অবাক করে চন্দ্রকুমারকে। দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবার সময় বিদায়ী পোষ্টমাস্টার তাকে ওর ব্যাপারে জানিয়েছিলেন: সে দৈনিক আসে আর একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। তিনি এর পেছনকার কারণটা অবশ্য বলে যাননি।হায়! ওর স্বামী কি প্রবাসে থাকে? কিংবা সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত? সে কি স্বামীর  প্রেমময় চিঠির জন্যে অপেক্ষমান? তা-ই সত্যি হতে পারে,চন্দ্রকুমার অনুভব করে। নারীরা মানুষ হিসেবে ভালো। হৃদয়ের দিক থেকে তারা উত্তম। তাদের হৃদয় ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ন থাকে। পুরুষেরাই বরং মন্দ। হৃদয় বলতে কিছু নেই তাদের। নারীর প্রতি ঘেন্না পোষণ করে তারা। নারীর উপর অত্যাচার চালায়। স্বামী ওর কাছে প্রেমময় চিঠিপত্র না লিখে থাকতে পারছে কী করে? সে কি খারাপ মানুষ একজন? স্ত্রীর জন্যে কি ভালোবাসা বলতে কিছু নেই তার? আগামীকাল জিজ্ঞেস করে নেবো ওকে। সত্যিটা জেনে নেবো। সাধ্যমতো সাহায্য করবো ওকে। চন্দ্রকুমার ভাবতে থাকে।

পরদিন সে আসে। বরাবরের মতো জিজ্ঞেস করে:

– আমার জন্যে কি কিছু এসেছে—-?

– না, কিন্তু—-। চন্দ্রকুমার বলে।

ডাগর চোখে তাকায় সে। চোখের ভাষায় সে যেনো বলে:

– বলুন—?

– মাফ করবেন—একটি প্রশ্ন—-আশা করছি, মাফ করবেন আমাকে। একটি প্রশ্ন করতে চাইছি। অন্যভাবে নেবেন না। আপনি প্রতিদিন এখানে আসছেন।দয়া করে বলবেন কি— এই দীর্ঘ অপেক্ষা কীসের জন্যে? চন্দ্রকুমার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।

– আরে, তেমন কিছু না—-দুই বছর আগে এক নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলাম। ওরা বিনিময়ে আমার জন্যে মানি অর্ডারে কিছু টাকা পাঠাবে বলেছিলো,

এজন্যেই প্রতিদিন এখানে আসা আর কি।

চন্দ্রকুমার যেনো আকাশ থেকে পড়ে।

মোহাম্মদ শাহজাহান: অনুবাদক, কলামিষ্ট ও আইনজীবী।


শেয়ার করুন