অনুবাদ গল্প : মায়ের চাকুরি

ad-mohammad-shajahanমূল: দীপক শর্মা
অনুবাদ: মোহাম্মদ শাহজাহান

[ দীপক শর্মা বিখ্যাত ভারতীয় নারীবাদী লেখিকা। জন্ম ১৯৪৬ সালে। হিন্দী ভাষার এই লেখিকার বারোটি ছোটগল্প-সংকলন প্রকাশিত হয়েছে এ পর্যন্ত। লক্ষ্ণৌয়ের এক কলেজে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। বর্তমানে সার্বক্ষণিকভাবে লেখালেখিতে জড়িত। এখানে পত্রস্থ তাঁর ছোটগল্পটি মূল হিন্দী থেকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন অনুবাদক ধীরাজ সিং।]

বাবা কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরতেই বড় কাকী খবরটি দেন তাঁকে:
– একজনকে চাকুরিতে নেবে ওরা। মহিলাই নেবে—- কাপড়ের কারখানাটায়। সকালের শিফটে। সকাল সাতটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত কর্মঘন্টা। বেতনটাও ভালো। তিন হাজার টাকা। চাকুরিটা কার্তিকির জন্যে উপযুক্ত——।
– কার্তিকির জন্যে? ওই শ্বাস-যন্ত্রটার জন্যে? বাবা বিদ্রুপাত্বক বিস্ময়ে বলেন।
বাবা মায়ের জন্যে একেক সময় একেক নাম উদ্ভাবন করেন। কখনও কখনও মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাটি নিয়ে আফসোসও করেন। মা দীর্ঘদিন ধরে এজমায় ভোগছেন। কিন্ত তাই বলে বাড়িতে হাত গুটিয়ে বসেও থাকেননি তিনি। বরং পুরো এলাকার মানুষের কাপড় সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকেন। ফলে কখন যে তাঁর জোরে জোরে শ্বাস নেবার শব্দ শুনছি আর কবে তাঁর কক্ষ থেকে সেলাই মেশিনের শব্দ ভেসে আসছে বুঝতে পারি না। রাতের বেলা মাঝেমধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসে তাঁর কষ্টটা টের পাই। তাই মা কবে যে শেষ নিশ্বাসটিই ত্যাগ করে বসেন-এ ভয়টি তাড়া করে আমাকে।
– কার্তিকির জন্যে না তো কার জন্যে আর? চাকুরিটা করার মতো সময় আমার আছে বলে মনে হয় তোমার? বড় কাকী মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাটার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বলেন।
বড় কাকী আমাদের বাড়ির অবিসংবাদিত রাণী। গত সতের বছর ধরে। নববধূ হয়ে তিনি এ বাড়িতে এসেছিলেন- কারণ, আমার দাদু আমার বড় কাকুর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বড় কাকুর বয়স তখন মাত্র তেইশ বছর। ওই সময়ে বড় কাকু বিয়ের পিঁড়িতে বসার চিন্তা বাদ দিয়ে বরং হন্যে হয়ে একটা চাকুরিই খু্ঁজছিলেন। কিন্তু এর কিছুদিন আগে দাদীমা মারা যাওয়ায় দাদু বাড়িতে একজন মহিলা থাকা দরকার বলে মত দিচ্ছিলেন বারবার। যেনো ওই মহিলা বাড়ির পুরুষ মানুষগুলোর দেখভাল করতে পারেন। তাছাড়া, তাঁর পনের বছর বয়সের মেয়েটিও মানসিক রোগে ভোগছিলেন। এ অবস্থায় অন্তত: রান্না ঘরের দায়িত্ব নেবার জন্যে হলেও তো একজন মহিলা দরকার। কিন্তু দু:খের বিষয়, দাদু বড় কাকীর রান্না বেশিদিন উপভোগ করতে পারেননি। বড় কাকীর এ বাড়িতে আগমনের দেড় বছরের মাথায় তিনি মারা যান। এর বছর চারেক পরে বড় কাকুও মৃত্যুবরণ করেন।
– ওর কাজটা কী হবে ওখানে? বাবা জানতে চান।
– তুলো ধোয়ার কাজ। বড় কাকী বলেন।
– তাহলে মাকে এ ধরণের কাজের ধারে-কাছেও ঘেঁষতে দেয়া যাবে না। কারণ, তুলো ধোয়ার কাজ তো তরল ক্লোরিণ দিয়ে করা হয়। এটি এজমা রোগীদের জন্যে বিপদজনক—। আমি আর না বলে থাকতে পারি না। ব্যাপারটি আমার অষ্টম শ্রেণির রসায়ন বিজ্ঞানের বই থেকে জানতে পেরেছিলাম।
– যেনো সবজান্তা একজন আর কি! তুই কি জানিস, দু’মুঠো খাবার যোগাড় করাও কতোটা কঠিন ইদানিং? পাঁচ জনের খাবার যোগাতে হচ্ছে মাত্র একজনকে—-।
আমি বাবার সঙ্গে তর্কে জড়াতে চাই না।তাই চুপ করে থাকি। একবার মনে হয়, বলেই ফেলি যে, শিক্ষকতা করে শুধু বাবাই উপার্জন করছেন না, পাশাপাশি মায়ের সেলাইয়ের কাজ থেকেও ঘরে দুটো পয়সা আসে।
মায়ের স্বাস্থ্যের প্রতি আমি ছাড়া আর কারও খেয়াল নেই। বাবা আর তাঁর মানসিক রোগাক্রান্ত বোন মাকে তেমন পছন্দ করেন না। বড় কাকীর সঙ্গে ওদের ভাবসাব যে রকম, তাতে ওদের কাছে মায়ের কদর ঘরের আসবাবপত্রের চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু মায়ের সঙ্গে বড় কাকীর দহরম-মহরম সম্পর্ক। মায়ের মতে, এর কারণ হলো, বড় কাকী জানেন, তিনি বাবার উপর কতোটা নির্ভরশীল।
– আমি যাবো ওখানে কাজ করতে। ওই চাকুরিটা করতে কোন সমস্যা হবে না আমার।সেলাইয়ের ঘর থেকে গলা চড়িয়ে মা বলেন।
বড় কাকী আর মা পরস্পর দূর সম্পর্কের বোন। আসলে বড় কাকীই বাবা ও মায়ের মধ্যে বিয়েটা দিয়েছিলেন। তেরো বছর আগে, বড় কাকুর মৃত্যুর পরে।
– আমি নিজে গিয়ে কথা বলে আসবো ওদের সঙ্গে- কখন কাজে যোগ দিতে পারবে, দেখি। বাবা বলেন।
মা এর পরদিনই ওই কাপড়ের কারখানায় কাজে যোগ দেন। এ কারণে সকাল বেলা মায়ের সঙ্গে আমার এখন আর দেখা হয় না। মাকে ছাড়া সকালগুলো কেমন যেনো নীরব- নিস্তব্ধ বলে মনে হয়। যেমনটি তাঁর সেলাইয়ের মেশিনটিও নীরবে পড়ে আছে। বিকেল তিনটার পরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েন মা। সেলাই মেশিনে কাজ করা বা একটু বসে আমার সঙ্গে দুটো কথা বলার মতো অবস্থা তাঁর থাকে না। এ কারণে মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাটিও যেনো বিদায় নিয়েছে আমাদের জীবন থেকে। একই কারণে মা আর আমার মধ্যে দূরত্বটাও যেনো বেড়েই চলেছে। আমি অনুভব করতে শুরু করি, মা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন-আসন্ন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে ঘুমেও দু:স্বপ্ন দেখি-মায়ের মৃতদেহ পড়ে আছে বা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন তিনি।
একদিন বিরতির পরেই আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে যায়। স্কুলের ঘন্টা-বাজানো বুড়োটি আকস্মিক মারা যান। উঁচুমতো যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে রোজ ঘন্টা বাজাতেন, সেখান থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। যুগপৎ শোক ও রাগের মিশেলে শ্রেণি শিক্ষক খবরটা জানান আমাদের:
– গত দুই বছর ধরেই অসুস্থ ছিলো বুড়োটা। কতো করে বললাম- অবসর নাও, অবসর নাও। কিন্তু শোনলো না- রোজকার মতো স্কুলে এসে হাজির। আরও বলে কিনা, কোন অসুবিধা নেই, কাজ চালিয়ে নিতে পারবে—ঘন্টা বাজানো নাকি নাক চুলকানোর মতোই সহজ কাজ।
চাকুরি করতে গিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েন মা। একদিন মাকে দেখার জন্যে ওই কারখানায় যেতে সিদ্ধান্ত নিই। কারখানায় পৌঁছে জানতে পারি, মা মহিলা কর্মীদের সঙ্গে বড় কক্ষটায় কাজ করছেন।
আমি ভেতরে ঢুকে পড়ি।বড়সড় একটি কক্ষকে দুই অংশে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে বড় বড় তুলোর পিন্ড থেকে সুতো তৈরি করা হচ্ছে। আর দ্বিতীয় অংশে সুতোগুলো থেকে মোটা মোটা কাপড়ের থান বানানো হচ্ছে।
আরেকটি বড় কক্ষে প্রবেশ করতেই ক্লোরিনের তীব্র গন্ধ এসে লাগে নাকে। চোখ দুটো জ্বালা করে ও অশ্রুতে টলমল করে উঠে। গন্ধটা সয়ে উঠতেই বুঝতে পারি, বাষ্পটা বর্গাকৃতির একটি পাকা গর্ত থেকে আসছে যেখানে তাজা তুলো চুবানো হচ্ছে। এই কক্ষটিতে কেবল মহিলারাই কাজ করছেন। এদের কেউ কেউ ডাক্তার বা সেবিকাদের মতো মুখে মুখোশ পরে আছেন। মুখোশের আড়ালে মুখ-ঢাকা এই মহিলাদের মধ্যে আমি মাকে খুঁজতে থাকি। আরেকটু ভালোভাবে খোঁজার জন্যে আমি কক্ষটার এক কোণে গিয়ে দাঁড়াই। দেখি, মা কক্ষটার অন্য প্রান্তে একদল মহিলার সঙ্গে ধোয়ার জন্যে তুলো খোলার কাজ করছেন। আমি তাঁকে পরণের শাড়ি দেখেই চিনতে পারি, মুখ দেখে নয়। কারণ, তাঁর মুখটি মুখোশে ঢাকা। ওখানে ওই অবস্থায় মাকে দেখে একেবারেই অচেনা কেউ বলে মনে হয় আমার। গোটা দুনিয়াকে বিস্মৃত হয়ে হাতের কাজটিতে মগ্ন হয়ে আছেন মা। তুলোর যে গাঁটটি খুলছেন তাতেই তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ। মুখের পেশীগুলো কুঞ্চিত হয়ে আছে। যেনো কাউকে আক্রমণে উদ্যত হয়েছেন তিনি। যেনো কাপড় আর তাঁর মাঝখানে যে-ই এসে দাঁড়াক, তাকেই তিনি আক্রমণ করে বসবেন।
আমি তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। তবে তিনি আমার উপস্থিতি টের পান না।
– তুমি বড্ড বেশি হাসছো, কার্তিকি।কর্তৃত্বময় কন্ঠে এক মহিলা বলেন।
মা হাসেন। একটু পরেই হাসিটা আরও জোরালো হয়ে উঠে। মাকে আর কখনও ওভাবে হাসতে দেখিনি। হয়তো বা এই হাসিটুকু তিনি চাপা দিয়ে রেখেছিলেন এতোদিন। আর এখন শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই তাঁর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে তা।
– তাড়াতাড়ি করো, হাত লাগাও। আরও জোরে। মনোযোগ দিয়ে কাজ করো। দেখো, কাপড়ে কোন ভাঁজ যেনো না থাকে। আজই এগুলো পাঠাতে হবে—–। ওই মহিলা আবারও বলেন।
– ঈশ্বর, সহায় হও।
তিন শব্দের মজাদার ও গুরুতর এই শব্দগুচ্ছটি আমার চেনা। মা-ই এ রকম বলেন। তাঁর প্রকাশভঙ্গী এমনই- দিনে বহুবার এ কথাটি উচ্চারণ করেন তিনি—বিশেষ করে যখন বাবা তাঁকে বকাঝকা করেন বা তাঁর মানসিক রোগাক্রান্ত বোন মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেন কিংবা বড় কাকী যখন মাকে একের পর এক উপদেশ বিলোন তখন।
– ঈশ্বরকে কার সহায় হতে বলছো? ওই হিটলারি মহিলার? মায়ের পাশে-বসা এক মহিলা জিজ্ঞেস করেন।
– ঈশ্বর সবার সহায় হোন। কেবল কার্তিকির জা ছাড়া। ওই রাক্ষসীটা দেবরের সঙ্গে লটর-পটর করার জন্যে নিজের স্বামীকে পরপারে পাঠিয়ে কার্তিকির জীবনটাও ছারখার করে দিয়েছে। আরেকজন মহিলা বলে উঠেন।
– কিন্তু এখন আর ওই অবস্থা নেই। ওই নরকটা আমার নয় আর। ওটা এখন ওরই। আমি আমার স্বর্গ খুঁজে পেয়েছি। এখানেই। মা হেসে বলেন।
অদ্ভূদ এক অনুভূতি আমাকে ঘিরে ধরে। দ্বিধাগ্রস্থ আমি মায়ের দিকে আর এগোতে পারি না। শ্বাসকষ্টে-ভোগা যে মাকে আমি সারা জীবন দেখে এসেছি, তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ বলেই মনে হয় তাঁকে। সে মুহুর্তে মা আমাকে দেখতে না পেলেও আমি তাঁর জীবনের এমন একটা অনুষঙ্গ দেখতে পাই যা এর আগে আর কখনও দেখিনি।
আমি মায়ের কাছ থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছি।
আমি ওখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়াই।কারণ, মায়ের জন্যে উদ্বিগ্ন বোধ করার দরকার নেই আর।

মোহাম্মদ শাহজাহান: অনুবাদক, কলামিষ্ট ও আইনজীবী।


শেয়ার করুন