আজ কবি আল মাহমুদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী

ইসলাম মাহমুদঃ

তিনি আর কখনো আসবেন না লোকালয়ে, অমর একুশে বইমেলায়। আসবেন না সৌম্য দৃষ্টি নিয়ে। আজ কবি আল মাহমুদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।

১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আশীর্বাদ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য কবি আল মাহমুদ।১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি ২০১৯ সালের আজকের এই দিনে (১৫ ফেব্রুয়ারি) ইহকাল ত্যাগ করেন, আজ তাঁর ২য় মৃত্যু বার্ষিকী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিভৃতপল্লীতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছে প্রিয় কবি।

পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত সাহিত্যের সব্যসাচী কবি আল মাহমুদ কবিতা ছাড়াও লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া, আত্মজীবনী ইত্যাদি। এ যাবৎ তার প্রকাশিত শতাধিক গ্রন্থ নিয়ে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য মোট ১৩ খণ্ডে প্রকাশ করেছে ‘আল মাহমুদ রচনাবলি’। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের প্রথম কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর’। এর তিন বছর পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তার আরো দু’টি কবিতার বই ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালি কাবিন’। এর মধ্যে ‘সোনালি কাবিন’ তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। এ ছাড়া তার ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।

একজন কবি যেন দেবদুত হয়ে পৃথিবীতে আসে। আর লিখে যায় শব্দবলী তার ঈশারায়
অবাক লাগে ওনার মৃত্যুদিন উনি আগেই বলে গেলো

— আল-মাহমুদ
কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।
ফেলে যাচ্ছি খড়কুটো, পরিধেয়, আহার, মৈথুন–
নিরুপায় কিছু নাম, কিছু স্মৃতি কিংবা কিছু নয়;
অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে জমে আছে শোকেরলেগুন
কার হাত ভাঙে চুড়ি? কে ফোঁপায়? পৃথিবীনিশ্চয়।
স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক
অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?
কেন দোলে হৃদপিণ্ড, আমার কি ভয়ের অসুখ?
নাকি সেই শিহরণ পুলকিত মাস্তুল দোলায়!
আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার
যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন ।

১.
আমি ঢাকায় এসেছিলাম খদ্দরের পিরহান গায়ে, পরনে খদ্দরের পায়জামা, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল এবং বগলের নিচে গোলাপফুল আঁকা ভাঙা সুটকেস নিয়ে। এসেছিলাম অবশ্যই কবি হতে। আজ অনেক বছর শহরে আছি। আমার সুটকেসের ভেতর আমি নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশের সবগুলো নদী, পাখি, পতঙ্গ, নৌকা, নর-নারীসহ বহমান আস্ত এক বাংলাদেশ।

২.
যেমন, যাদুকররা তাঁদের দ্রষ্টব্য দেখান। তেমনি আমি ভাঙা সুটকেস থেকে জাতিকে দেখিয়েছি। আমার দ্রষ্টব্য দেখে বাংলার মানুষ কখনো কখনো হাততালি দিয়েছেন, আবার কখনো অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। আমি যখন এসেছিলাম তখন আমার বন্ধুদের বগলের নিচে থাকতো সিলেক্টেড পয়েমস জাতীয় ইউরোপের নানা ভাষার নানা কাব্যগ্রন্থ।

আমি যেমন আমার ভাঙা সুটকেস থেকে আমার জিনিস বের করে দেখিয়েছি তারাও তাঁদের বগলের নিচের পুঁজি থেকে নানা ভেলকি দেখিয়েছেন। এখনো আমি এই শহরেই আছি। আমার সেসব বন্ধুদের আমার মতো সৌভাগ্য হয়নি। এই নগরীতে তাঁদের নাম তরুণরা উচ্চারিত হয় না।

একটি কথা মনে রাখবে- সাহিত্য কোন প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিলো না, এখনো নেই। এটা ছিলো আনন্দের বিষয়, ভষ্যিতেও তাই থাকবে।

কারোরই বুঝার বাকি নেই কার কথা বলছি। হ্যাঁ, শুনছিলেন আধুনিককালের শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ এর নিজের মুখ থেকে নিঃসৃত ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকা আসার গল্প।
এই মহা কবি

কট্টর বাম থেকে ডান মেরুতে আসা কবির কথাগুলো শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। চলুন কবির এই কাল সেকালের আরও কিছু কথা শুনি।

৩.
সে সময় আমি গণকণ্ঠের সম্পাদক ছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের পরিবারকে চিনতেন। উনি আমাকে বলতেন যে, উনি যখন ছাত্র ছিলেন, কোলকাতায়, তখন আমার চাচাতো ভাই, চাচা তাঁদের সঙ্গে তাঁর ভালো পরিচয় ছিল। আমি অবশ্যই জানতাম না অতো কিছু। আমি একটু উদাসীন ধরনের মানুষ ছিলাম তো। কবিরা এমনই হয়। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কবির উপরোক্ত মন্তব্য।

৪.
কবি আল মাহমুদ পুরো একটি জীবন কবিতার পথে কাটিয়ে গেছেন। কবি জীবনের সঙ্গে দারুণভাবে মিশে আছে বাংলাদেশের বাঁক-বদলের ইতিহাস। স্বদেশের শক্তি বুকে নিয়ে, চোখে জাতির স্বপ্ন দিয়ে এখনো তিনি লিখে চলছেন সমান তালে।

এই মহান সাধক কবি হয়েও পাঠকের কাছে চমৎকার ভাষায় পৌঁছে দিয়েছেন গল্প, উপন্যাস। সোনালি কাবিন কবির অমর সৃষ্টি। তাঁর গল্প থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ওপার বাংলার কলকাতায়। কিন্তু এপার বাংলায়?

কবি বাম ঘরানা থেকে ডানপন্থী লেখায় আত্মনিয়োগ করার পর থেকে সরাসরি রাষ্ট্র কর্তৃক উপেক্ষিত হয়েছিলেন। মিডিয়া ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীপাড়ায় তো আরো আগেই অবহেলিত। মৃত্যুর পরেও যথাযথ সম্মানটুকু পাননি। আহা! বড়ই আফসোস এই জাতির জন্য।

কবির ঘোষণা ছিলো-
“আমাদের এ মিছিল নিকট অতীত থেকে অনন্ত কালের দিকে,
আমরা বদর থেকে ওহুদ হয়ে এখানে,
শত সংঘাতের মধ্যে এ কাফেলায় এসে দাঁড়িয়েছি।

কে প্রশ্ন করে আমরা কোথায় যাবো ?
আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।”

হে আল্লাহ, আমাদের প্রিয় কবির অনন্তকালের যাত্রাকে তুমি সহজ করে দিও। জান্নাতের সুবাতাস বইয়ে দিও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই সাড়ে তিনহাত কবরে।


শেয়ার করুন