বিকল্প পথের খোঁজে জামায়াত

1361549103Jamaat-logo-new2সিটিএন েডেস্ক:

দীর্ঘদিন ধরে অস্তিত্ব সংকটে থাকা জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক কার্যক্রম একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে। নেতৃত্বহীনতায় ভুগছে সারা দেশে দলটির হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে আপস না করেই সংগঠনকে শক্তিশালী করা ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরতে বিকল্প চিন্তায় মগ্ন দলটির নীতিনির্ধারণী মহল। দলটির কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় সবখানেই নির্দেশনা পাওয়ার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য নেতা খুঁজে পাচ্ছেন না দলের কর্মীরা। দলটির আমির, নায়েবে আমিরসহ শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতাই বর্তমানে কারাগারে। এ ছাড়া সেক্রেটারি জেনারেল ও দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের ফাঁসি ইতোমধ্যেই কার্যকর করা হয়েছে। আর জেলের বাইরে যেসব নেতাকর্মী রয়েছেন, তারাও নানা মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এ ছাড়া দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় তৃণমূল থেকে শুরু করে শীর্ষপর্যায় পর্যন্ত দলের নেতৃত্ব ভেঙে পড়াসহ অসংখ্য সমস্যার সম্মুখীন দলটি রাজনৈতিক অঙ্গনে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তবে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এককভাবে প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। এ জন্য তফসিল ঘোষণার আগেই দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী সমর্থকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সে মোতাবেক নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করছেন পাড়া-মহল্লা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। কর্মকৌশল নির্ধারণে চলছে গোপন বৈঠক।
চার বছর ধরে বন্ধ কেন্দ্রীয়সহ সারা দেশের দলীয় কার্যালয়। মামলা-হামলার কারণে প্রকাশ্যে রাজনীতি করা দূরে থাক, বেরই হতে পারেন না দলের নেতাকর্মীরা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অর্থনৈতিক, সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিকভাবে এত বড় বিপর্যয়ে এর আগে কখনো পড়েনি দলটি। গেল বছরও দলটির রাজনৈতিক কর্মকা- ছিল বিপর্যস্ত। শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির পর নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি দিলেও রাজপথে প্রভাব দেখাতে সক্ষম হয়নি। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা দেখা গেছে বেশি। এখন পর্যন্ত সে অবস্থায়ই রয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। দিন যতই যাচ্ছে, ততই জামায়াতের সাংগঠনিক কর্মকা- ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছে। মাঠে হারাচ্ছে সাংগঠনিক ভিত্তি। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে দলটির নেতাকর্মীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিলেন, কালের পরিক্রমায় সে দলটিই এখন ধুঁকছে চতুর্মুখী চাপে। এমতাবস্থায় দলটির নেতাকর্মীদের রাজপথে সক্রিয় করতে ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি চালিয়ে যেতে বিকল্প পথের খোঁজে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একাধিক গোপন বৈঠক হয়েছে বলে জামায়াত সূত্র জানিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখী হওয়া শীর্ষ নেতাদের ব্যাপারে টু-শব্দ না করে শুধু রাজনীতির পথটাকে পরিষ্কারভাবে ব্যবহারের সুযোগ চাচ্ছেন পার্টির চিন্তাশীল নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারটুকু পাওয়া গেলে দলের নেতাকর্মীরা অন্তত মাঠে অবস্থান নিতে পারবেন। তাহলে জামায়াত রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হলেও বিকল্পভাবে ঘুরে দাঁড়াবার আশা জাগিয়ে রাখবে। এ অবস্থায় দলটির নেতাকর্মীদের মাঠপর্যায়ে সংগঠিত করতে তৃণমূল পর্যায়ের ইউপি নির্বাচন দলটির জন্য অনেকটা সুবিধা করে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা। সে অনুযায়ী দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা নির্বাচন উপলক্ষে প্রকাশ্যে সংগঠিত হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বর্তমানে জামায়াতের ২১ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের মাত্র দুজন সদস্য প্রকাশ্যে থাকলেও তারা দলীয় কর্মকা-ে আশানুরূপ সক্রিয় নন। আর ধারাবাহিকভাবে প্রবীণ নেতাদের পদ শূন্য হওয়ার ফলে নির্দেশনা দেয়ার মতো কেউ থাকছেন না। এ অবস্থায় পুলিশ এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হামলা-মামলার ভয়ে ঘরে-বাইরে কোথাও সভা-সমাবেশ করতে পারছে না দলটি। গোপনে ঘরোয়া সভা করতে গিয়েও বারবার ধরা পড়ছেন দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মী ও সমর্থক। এ প্রসঙ্গে জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর এক নেতা বলেন, দলের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে প্রবীণ নেতাদের পদ শূন্য হওয়ায় নেতৃত্ব সংকট তৈরি হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ বিচার প্রক্রিয়া শেষে ইতোমধ্যে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার। আরো অন্তত এক ডজন নেতা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফাঁসির দ- মাথায় নিয়ে কারাগারে আটক রয়েছেন। যদিও দ-প্রাপ্তদের সবাই সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন। দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিল রায়েও মৃত্যুদ- বহাল রয়েছে। এখন অপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের। আপিল শুনানির শেষ পর্যায়ে রয়েছে মীর কাসেম আলীর মামলা। এ ছাড়া আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছেন এ টি এম আজহারুল ইসলাম, মাওলানা আবদুস সোবহানসহ অন্যরা।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগরের বেশ কয়েক নেতা জানিয়েছেন, আগামী দিনে জামায়াতের মাঠে রাজনীতি করা খুব কঠিন হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব নেতা বলেন, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে জামায়াতকে সরকার নানা ধরনের মিথ্যা কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত করে অপপ্রচার চালিয়ে সুনাম ক্ষুণœ অব্যাহত রাখছে। যার ফলে দেশ-বিদেশে জামায়াতের রাজনীতি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। একইভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার টার্গেট হয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এ ব্যাপারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার এক সদস্য বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের শিকার জামায়াতের ঘুরে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগবে। বিগত ৫ বছরে জামায়াতের যে ক্ষতি হয়েছে, অতীতে এ ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি দলটির নেতাকর্মীদের। এ অবস্থা থেকে কেটে না উঠলে অদূর ভবিষ্যতে জামায়াত নামে সংগঠনটি পরিচয় সংকটে ভুগতে পারে।
এদিকে জামায়াতের মূল ভিত্তি হিসেবে পরিচিত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন হুমকির মুখে পড়েছে। হাতছাড়া হয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে দলের নামে ও বেনামে সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামায়াতপন্থী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরই অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে অনুসন্ধান ও তদন্ত শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, সারা দেশে জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত মোট ৫৬১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ব্যাংক, বিমা, সমিতি), সেবামূলক প্রতিষ্ঠান (হাসপাতাল, ক্লিনিক), শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কোচিং সেন্টার, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট), এনজিও ও সামাজিক সংগঠন রয়েছে। সংগঠনের নেতাকর্মীরা এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে তাদের দলীয় বিশ্বাস ও কর্মকা-ের প্রচার চালাচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বৈদেশিক সাহায্যের নামে বিপুল অর্থ দেশে এনে তা তাদের সংগঠনের পেছনে ব্যয় করার পাশাপাশি বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনকে আর্থিক সাহায্য দেয়া হচ্ছে।
এদিকে গত ১৫ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধ হলে ইসলামী ব্যাংকসহ তাদের সব ধরনের আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। তিনি বলেছেন, যে আইনে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে, সে আইনেই তাদের নিয়ন্ত্রিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে ব্যাখ্যা থাকবে। ভোরের কাগজ


শেয়ার করুন