এমন প্রতিদান ক’জন পায়!

protidan-400x300হিন্দ, ডাক নাম উম্মে সালামা। পিতা মাখযুম গোত্রের প্রধান। একজন বিখ্যাত দানবীর! আবু উমাইয়া ইবনুল মুগিরা আল কুরাইশী। স্বামী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল আসাদ। ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম দশ জনের একজন।
উম্মে সালামা স্বামীর সঙ্গে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন। ইসলামের অগ্রগামীদের মধ্যে তিনিও একজন।
সে সময়ে কারো ইসলাম কবুলের কথা শুনলে কুরাইশদের মাথা গরম হয়ে যেত। শুরু করত নির্যাতন! উম্মে সালামা ও তার স্বামীর উপর শুরু হল অত্যাচার। দুর্বিষহ শাস্তি তাদের কে দেয়া হত প্রতিনিয়ত। কিন্তু সকল অত্যাচার ও শাস্তি নীরবে সহ্য করে ঈমানের ওপর তারা রয়ে গেলেন অবিচল। বিন্দুমাত্র শক্তিহীন ও দুর্বল হলেন না। হলেন না ক্লান্ত ও দ্বিধান্বিত!
যখন তাদের যন্ত্রণা আরো বৃদ্ধি পেল, তখন রাসুলুল্লাহ সা. সাহাবীদের অনুমতি দিলেন হাবশায় হিজরতে। অনুমতি পেয়ে দুজনই চলে গেলেন হাবশায়। মক্কায় ফেলে গেলেন ধন সম্পত্তি, উচ্চ মর্যাদা আর গৌরবগাথা বংশ।
সবকিছু বিসর্জন দিলেন আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাওয়ার প্রত্যাশায়, আল্লাহর সন্তুষ্টির কাছে সবকিছুকে তুচ্ছ করে।
উম্মে সালামা ও তার সাথীরা হাবশার বাদশা নাজ্জাশীর সার্বিক সহযোগিতা পাওয়া সত্তেও অহীর অবতরণ ক্ষেত্র মক্কার প্রতি এবং প্রিয়নবীর প্রতি টান অনুভব করেন। উম্মে সালামা ও তার স্বামী তো প্রিয়নবীর জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন।
হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব এবং উমর ইবনে খাত্তাব ইসলাম গ্রহণ করেছেন। মুসলমাদের সংখ্যা বাড়তে লাগল দিন দিন। কুরাইশদের অত্যাচার কিছুটা কমেছে। এমন খবরে কিছুটা অনুপ্রাণিত হয়। স্বীয় জন্মভূমির মায়া, রাসুলের মহব্বত তাদের কাছে টানে।
একদিন উম্মে সালামা ও তাঁর স্বামী হাবশা ছেড়ে মক্কায় ফিরে এলেন।
কিন্তু প্রাপ্ত সংবাদ ছিল অতিরঞ্জিত! হামযা ও উমরের ইসলাম গ্রহণের কারণে মুসলিমগণ যেটুকু সাহস দেখাতে চেয়েছিলেন কুরাইশরা সেটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে সীমাহীন অত্যাচার চালিয়ে, মক্কার অবস্থা আরো ভয়াবহ করে তুলেছে।
নাজুক পরিস্থিতিতে রাসুলুল্লাহ সা. সাহাবীদের অনুমতি দিলেন মদীনায় হিজরতের। অনেকের সঙ্গে উম্মে সালামা ও তার স্বামীও হিজরতকারীদের তালিকায় উঠে গেলেন।
কিন্তু উম্মে সালামা রা. ও তার স্বামীর জন্য হিজরত তত সহজ ছিল না যেমন তারা ভেবেছিলেন। হিজরত করতে গিয়ে তারা মুখোমুখি হয়েছিলেন কঠিন ও বেদনাদায়ক অত্যাচারের। যা রেখে গেল তাদের জীবনে ভয়াবহ ও করুণ বিয়োগান্ত স্মৃতি!
হিজরতের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। একটি উটের উপর উম্মে সালামা ও সালামা বসিয়ে দিলেন আবু সালামা। কোন দিকে না তাকিয়ে তিনি উটের রশি ধরে যাত্রা শুরু করলেন মদীনার পানে।
মক্কার সীমানা পার হওয়ার আগে ‘মাখযুম’ গোত্রের কিছু লোক তাদের দেখে ফেলে। পথ আগলে দাঁড়ায় তারা।
আবু সালামাকে বলে, যদি তোমার পরাজয় ঘটে তাহলে তোমার স্ত্রীর কী হবে? সেতো আমাদের মাখযুম গোত্রের মেয়ে, তাকে আমাদের মাঝ থেকে নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবে, তোমাকে কিসের ভিত্তিতে এই সুযোগ দেব?
এই বলে উম্মে সালামাকে আলাদা করে নিল সম্প্রদায়ের লোকেরা। কোনোভাবেই আর তাদের কাছ থেকে উম্মে সালামাকে ফেরানো গেল না।
অবস্থা বেগতিক হয়ে গেল। আবু সালামাকে একাই চলে যেতে হলো মদীনায়। উম্মে সালামার সাজানো ছোট্ট বাগান তছনছ হয়ে গেল কয়েক মিনিটেই। প্রাণপ্রিয় স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন তিনি। উম্মে সালামা এখন একা। দিন কাটে বিরহে, কষ্টে!
সেই দিনের পর থেকে উম্মে সালামা রা. প্রতিটি সকালে বালুর সেই উপত্যকায় যান। যেখান থেকে বিচ্ছেদ হয়েছে স্বামী। সেখানে বসে বসে তিনি বিলাপ করেন রাতের অন্ধকার নামা পর্যন্ত।
এভাবে চলে দিন। কেটে যায় বছর। উম্মে সালামার দূরবস্থা দেখে আবু সালামার গোত্রের এক সর্দারের মনে করুণা জাগে। তিনি মাখযুম গোত্রের লোকদের কাছে গিয়ে বলেন, তাকে এভাবে আর কত কষ্ট দেবে? স্বামীর সন্তানের কষ্টে তো সে মৃত্যুর পথযাত্রী হতে বসেছে।
অনেক বুঝানোর পর এক সময় তাদের হৃদয় কোমল হলো। অবশেষে তারা বলল, উম্মে সালামা যাতে স্বামীর কাছে চলে যায়।
উম্মে সালামা এক মুহূর্ত বিলম্ব করলেন না। এমনকি সফরসঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করতে মন সায় দিল না। তিনি আশঙ্কা করলেন, না জানি অকল্পনীয় কোন ঘটনা ঘটে যায়। যা স্বামীর সাথে সাক্ষাতের পথে সৃষ্টি করবে অন্তরায়।
অবিলম্বে তিনি উট প্রস্তুত করলেন। কোলে তুলে নিলেন সন্তানকে! বের হলেন মদীনায় স্বামীর উদ্দেশে! সঙ্গে আল্লাহ ছাড়া কেউই নেই।
দীর্ঘ দিনের বিচ্ছিন্নতার পর তাদের সাক্ষাৎ হলো। চক্ষু শীতল হল সবার।
এর কিছুদিন পরই বদর যুদ্ধ! আবু সালামা রা. বীর বিক্রমে জিহাদ করে বিজিত হয়ে ফিরে এলেন।
তারপর উহুদ যুদ্ধ। এখান থেকে মারাত্মক জখম হয়ে ফিরলেন আবু সালামা! জখমের যন্ত্রণা তীব্র হচ্ছে। এক সময় পঁচন ধরল। তিনি হলেন পুরো শয্যাশায়ী!
একদিন আবু সালামা স্ত্রীকে বললেন, হে উম্মে সালামা! রাসুলুল্লাহ সা. কে বলতে শুনেছি, তিনি এই বলে দোয়া করেছেন, ‘হে আল্লাহ! তোমার কাছে আমার এই মুসিবতের প্রতিদান প্রত্যাশা করি। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে এর চেয়ে উত্তম বদলা দান করো।’ তাহলে আল্লাহ তাকে সেটা দান করেন। তুমিও এভাবে দোয়া করো। যেন তোমার কষ্টের বিনিময়ে আল্লাহ ভালো প্রতিদান দেন।
আরো কয়েকদিন শয্যাশায়ী থাকার পর আবু সালামা রা. ইন্তেকাল করলেন। রাসূলুল্লাহ সা. নিজে তার জন্য দোয়া করলেন। নিজ হাতে তাকে দাফন করলেন।
একদিন উম্মে সালামা রা. রাসুলুল্লাহ সা. এর বাণী স্মরণ করে তিনি দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ আমার এই মুসিবতের প্রতিদান তোমার কাছে প্রত্যাশা করি।’ কিন্তু তার পরের অংশটুকু বলতে ভাল লাগত না। তাই দোয়ায় ‘আমাকে এর চেয়ে উত্তম বদলা দাও’ এটা বলতেন না। কারণ তার মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগত, আবু সালামার চেয়ে উত্তম আর কে আছে?
স্বামী হারিয়ে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হলেন তিনি। দরিদ্র হওয়ায় চরম অর্থ কষ্টও দেখা দিল। তার বিপদে ব্যথিত হলেন মুসলিমগণ। এমন ব্যথিত তারা আর কারোর বিপদে হননি। তারা তার নামের সঙ্গে যুক্ত করলেন ‘আরবের বিধবা’ উপাধি।
কেননা ওই সময় তার আত্মীয় স্বজন কেউই জীবিত ছিল না মদীনায়, কেবল ছোট্ট মেয়েটি ছাড়া।
মুহাজির, আনসার সব সাহাবী অনুভব করলেন, উম্মে সালামার জন্য তাদের কিছু করণীয় রয়েছে। এগিয়ে এলেন আবু বকর রা.। বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন উম্মে সালামা রা.।
এরপর প্রস্তাব নিয়ে এলেন উমর রা.। তাকেও ফিরতে হলো আবু বকরের মতো।
কিন্তু তার কষ্ট দিন দিন বাড়তেই থাকল। অবস্থা দেখে সইতে পারলেন না প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা.। তিনিই প্রস্তাব নিয়ে এলেন।
জবাবে উম্মে সালামা বললেন।
-ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার তিনটি দোষ আছে।

এক. আমার আতœমর্যাদাবোধ খুব তীব্র, আমার আশঙ্কা হয়, এই দোষ আপনার সামনে প্রকাশ পাবে, যাতে আপনি কষ্ট পাবেন আর সে কারণে আল্লাহ আমাকে শাস্তি দেবেন।
দুই. আমি একজন বয়স্কা নারী, বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে।
তিন. আমার সন্তান আছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি যে আতœমর্যাদাবোধের কথা বলেছ, এ বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করব। তিনি তোমাকে এই দোষ মুক্ত করে দেবেন।
যে বয়সের কথা বলেছ, সেটা তো আমার বেলায় একই।
আর তুমি যে সন্তানের আপত্তি তুলেছ, সে বিষয়ে আমি বলবো, তোমার সন্তান হবে আমার সন্তান।
এবার আর বাধা থাকল না। বিয়ে হলো উম্মে সালামার। পৃথিবীর সবচে দামি মানুষটির সঙ্গে। আল্লাহ পাক উম্মে সালামা রা. এর কষ্টের প্রতিদান দিলেন। এমন প্রতিদান ক’জন পায়।


শেয়ার করুন