২০১৪ ফিরে দেখা : রামুতে জোড়া হত্যাসহ ১৮ খুন

firdekaসোয়েব সাঈদ, রামু:

রামু উপজেলায় ২০১৪ সালে ৩টি জোড়া খুনের ঘটনা সহ ১৮ জন খুন হয়েছেন। এরমধ্যে বাঁকখালী নদী থেকে যুবক মো. হাসানের মৃত দেহের টুকরো টুকরো অংশ উদ্ধারের বিষয়টি ছিলো আলোচনার শীর্ষে। এছাড়া খুনিয়াপালং ইউনিয়নের গোয়ালিয়াপালং গ্রামে মাতাল স্বামীর হাতে স্ত্রী জাকি ও গৃহ পরিচারিকা খুরশিদা এবং গর্জনিয়া ইউনিয়নের বনাঞ্চল থেকে গলা ও হাত-পা কাটা অবস্থায় আবদুর রহিম ও ইলিয়াছ নামের দুই যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার, কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের দুইল্লাছড়ি এলাকা থেকে আব্দুর রহিম ও আব্দুল আমিন নামের দুই শিশুর মৃতদেহ উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে এখনো জনমনে চাঞ্চল্য বিরাজ করছে। এক বছরে শিশুসহ দেড় ডজন ব্যক্তিকে হত্যার বিষয়ে উদ্বিগ্ন রামুর সর্বস্তুরের মানুষ। গত এক বছরে রামু সংগঠিত বিভিন্ন হত্যাকান্ডের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

সাহাব উদ্দিন:

১০ জানুয়ারি রামুর ঈদগড় বাজারে প্রকাশ্যে গণপিটুনিতে মারা যান, সাহাব উদ্দিন (৩০) নামের এক ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, অপহরন, চাঁদাজিসহ অসংখ্য অপকর্মের অভিযোগ ছিলো। নিহত সাহাব উদ্দিন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দক্ষিণ বাইশারীর মৃত ইসমাইলের ছেলে। তবে সাহাব উদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে ঈদগড়ের হাসনাকাটা এলাকায় বসবাস করছিল। সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে রামু,চকরিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় খুন,অপহরণ,চাঁদাবাজি,ডাকাতিসহ অর্ধডজন মামলা রয়েছে।

মো. হাবিব:

২ ফেব্রুয়ারি রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল তেচ্ছিপুল এলাকায় জিএমকে নামক ইটভাটায় শ্রমিকের ইটের আঘাতে মারা যান মো. হাবিব (২৮) নামের এক শ্রমিক। মো. হাবিব রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের মনিরঝিল এলাকার ফরিদুল আলমের ছেলে।

ব্যবসায়ি শাহ আলম:

রামু উপজেলার দক্ষিন মিঠাছড়ি ইউনিয়নের সমিতিপাড়ায় প্রতিপক্ষের হামলায় খুন হন ব্যবসায়ি শাহ আলম। নিহত শাহ আলম ওই এলাকার মমতাজ আহমদের ছেলে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সকাল আটটায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধিন অবস্থায় তিনি মারা যান।

হাফেজ আহমদ:

২২ জানুয়ারি রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের আইজ্যার বাপের ঘোনা বালুবাসা গ্রামে ধান ক্ষেতে পাহারা দিতে গিয়ে রহস্যজনকভাবে মারা যান হাফেজ আহমদ (৪৮) নামের এক ব্যক্তি। তিনি একই ইউনিয়নের মো. সোলাইমানের ছেলে।

কচ্ছপিয়ার দুই শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার:

২৩ জানুয়ারি রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের বড় জামছড়ি পশ্চিমকুল দুইল্লাছড়ি এলাকা থেকে দুই শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধারকৃত শিশুরা হলো, কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও‘র ইসলামাবাদ ইউনিয়নের খোদাইবাড়ি গ্রামের রোহিঙ্গা বসতির মোঃ শফির ছেলে আব্দুর রহিম (৭) এবং একই এলাকার আবদুস শুক্কুরের ছেলে আব্দুল আমিন (৮)। উদ্ধার হওয়ায় দুই শিশুর মৃতদেহ ময়না তদন্ত শেষে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগে এ ব্যাপারে থানায় মামলা করা হয়।

আহমদ নবী:

৭ মার্চ রামু উপজেলার ঈদগড় ইউনিয়নে আহমদ নবী (১২) নামের মাদ্রাসা ছাত্রের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। আহমদ নবী রামুর ঈদগড় ইউনিয়নের খরুলিয়ামুরা এলাকার আজগর আলীর ছেলে এবং ঈদগড় চরপাড়া নুরানী মাদ্রাসার ছাত্র ছিলো। পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, নিহত শিশুটিকে মাদ্রাসায় শিক্ষকরা মারধর করে এবং জ্ঞান হারালে তাকে চিকিৎসা না করিয়ে মাদ্রাসা থেকে এক কিলোমিটার দূরে ওই স্থানে ফেলে দেয়া হয়। ঈদগড় রেনুরছড়া ব্রীজের পাশে ধানক্ষেতে স্থানিয় লোকজন মৃতদেহটি দেখতে পায়।

কহিনুর আকতার:

২৪ জানুয়ারি রামু উপজেলার দক্ষিন মিঠাছড়ি ইউনিয়নের কাইম্যারঘোনা এলাকায় স্বামীর নির্যাতনে মারা যান অন্তঃস্বত্ত্বা গৃহবধু কহিনুর আকতার (২৩)। কহিনুর আকতার স্থানিয় নুরুল ইসলামের স্ত্রী। মৃত্যুর পর কহিনুর আকতারের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিলো।

পুলিশের সাথে গোলাগুলিতে অজ্ঞাত ডাকাতের মৃত্যু:

২০ এপ্রিল রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়কের রাবার বাগান এলাকায় পুলিশের গাড়িতে ডাকাতির চেষ্টাকালে ডাকাতদলের সাথে পুলিশের গোলাগুলির ঘটনায় অজ্ঞাত এক ডাকাতের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় রামু থানা পুলিশের এএসআই মিল্টন হাতে গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশের টহল দলের ব্যবহৃত একটি অটোরিক্সাকে (সিএনজি) ডাকাতদলের সদস্যরা ডাকাতির উদ্দেশ্যে ব্যারিকেড দিয়ে গতিরোধ করে। সিএনজি গাড়ির ভিতর পুলিশ ও আনসার সদস্যদের দেখে ডাকাতদল হতভম্ব হয়ে পড়ে। এসময় পুলিশ ডাকাতদলের মধ্যে গোলাগুলির এ ঘটনা ঘটে।

শিশু আবু রায়হান:

২৫ মে রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের মৌলভীকাটা দক্ষিন কেচুবনিয়া এলাকায় স্থানীয় মনজুর আলমের ছেলে আবু রায়হানের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আগেরদিন আবু রায়হান (৯০) বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। শিশুটির মৃতদেহে চারটি চুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিলো। শিশুটির পরিবারের সদস্যদের এ ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন জানায়, পরিকল্পিতভাবে আবু রায়হানকে হত্যা করা হয়েছে।

গর্জনিয়ায় হাত-পা ও গলা কাটা দুই যুবকের লাশ:

১১ আগষ্ট রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা নজু মাতব্বরপাড়া নাইম্যাছড়া থেকে দুই যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এরা হলেন, গর্জনিয়া ইউনিয়নের বড়বিল এলাকার বাসিন্দা আবদুল মোনাফ মিস্ত্রির ছেলে আবদুর রহিম (২৩) ও আবদুল মাবুদের ছেলে মো. ইলিয়াছ (২৫)। সহকারি পুলিশ সুপার (উখিয়া সার্কেল) মো. জসিম উদ্দিন মজুমদার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। উদ্ধার হওয়ায় দুই যুবকের গলায় ও দেহের বিভিন্নস্থানে ধারলো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে।

খুনিয়াপালংয়ে চাঞ্চল্যকর জোড়া খুন:

৮ সেপ্টেম্বর উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের গোয়ালিয়াপালং গ্রামে পারিবারিক কলহের জের ধরে স্বামীর হাতে খুন হন স্ত্রী তাহমিদা কবির জাকি’র (২২) ও গৃহকর্মী খুরশিদা বেগম (১০)। ঘটনার পর পরই অভিযুক্ত স্বামী রিদুয়ানকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত তাহমিদা কবির জাকির বাবা নুরুল কবির রামু থানায় মামলা করেন।

নৃসংশ হত্যাকান্ডের শিকার হাসান:

২০১৪ সালের শেষের ৪টি মাস জুড়ে আলোচিত ছিলো যুবক হাসানের নৃশংশ হত্যাকান্ড। হত্যাকান্ডের শিকার তরুন ব্যবসায়ি মো. হাসান (২৭) রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের মন্ডলপাড়ার জাকের আহমদের ছেলে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর হাসান বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। ওই দিন থেকে তার ব্যবহৃত মুঠোফোনও বন্ধ ছিলো। নিখোঁজ হওয়ার পাঁচদিন পর থেকে বাঁকখালী নদীতে সন্ধান মিলে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া হাসানের মস্তক ও হাত। পরে আবারো বাঁকখালী নদী থেকে উদ্ধার করা হয় বাহু থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বাম হাত। উদ্ধার হওয়া দেহের এসব অংশ অনেকখানি বিকৃত হয়ে গেছে। এরপরও অবয়ব আর আকার দেখে পরিবারের সদস্যদের ধারনা করে এটি মো. হাসানের মৃতদেহ। এ ধরনের নৃসংশ হত্যাযজ্ঞে হতবিহবল হয়ে পড়েছেন, হাসানের স্বজন ও রামুর সর্বস্তরের মানুষ। এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রামুর সর্বস্তরের জনতার উদ্যেগে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়েছে। এছাড়া হত্যার ঘটনায় হাসানের বড় ভাই ইসমাঈল বাদি হয়ে রামু থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় সন্দেহজনক বেশ কয়েকজনকে আটক করে পুলিশ।

মো. হাসানের স্বজনদের ধারনা হয়তো পরিচিত বা সংঘবদ্ধ একটি অপরাধি চক্র অপহরণ করে হাসানের সর্বস্ব লুট করতে গিয়ে তাকে হত্যা করে। পরে হত্যাকান্ড ধামাচাপা দিতে মৃতদেহ টুকরো-টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। তারা এ হত্যাকান্ডটি রামুতেই হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।

বাবুন বড়ুয়া:

১০ অক্টোবর বন্ধুর হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারান রামুর সদর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের মেরংলোয়া গ্রামের সুনীল বড়–য়ার ছেলে বাবুন বড়–য়া (২৬)। জানা গেছে, একই এলাকার ছেলে সুনু বড়–য়ার ছেলে রিপন বড়–য়া বিরোধের জের ধরে বাবুন বড়–য়ার মাথায় এবং মুখে আঘাত করে। পরে চমেক হাসপাতালে নেয়া হলে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নিহত বাবুন বড়–য়ার রামু থানায় লিখিত এজাহার দেন।

মাদকাসক্ত ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে বোনের মৃত্যু:

১১ অক্টোবর রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের খোন্দকারপাড়া এলাকায় মাদকাসক্ত ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান হাসিনা আক্তার (২৫)। হাসিনা আক্তার একই এলাকার জয়নাল আবেদীন বাহাদুরের স্ত্রী। এঘটনায় আহত হয়েছেন নিহত হাসিনা আক্তারের ভাই ছানা উল্লাহ (২০), বোন নাছিমা আক্তার (১৭) ও ভাবি জাহেদা বেগম (২০)। ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত ছানা উল্লাহকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ এ ঘটনায় অভিযুক্ত আমান উল্লাহকে আটক করে।

কুলসুমা আকতার:

২৪ নভেম্বর রামু উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়নের ছাগলিয়াকাটা এলাকায় পারিবারিক কলহের জের ধরে স্বামীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান কুলসুমা আকতার (২২)। কুলসুমা ওই এলাকার মো. শরীফের স্ত্রী এবং একই এলাকার বদিউল আলমের কন্যা। এ ঘটনায় অভিযুক্ত কুলসুমা আকতারের স্বামী মো. শরীফকে আটক করে পুলিশ। এ ব্যাপারে রামু থানায় মামলা করা হয়েছে।


শেয়ার করুন