সিটিএন ডেস্ক
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙ্গালী জাতির জীবনে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। একইসাথে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের বিষ্ফোরণও ঘটে এই দিনে। সেদিন স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের প্রণীত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে ছাত্র সমাজ।
এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরপরই শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। এতে শিশু বয়স থেকেই ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করে-শিক্ষার ব্যয়ভার বাড়ানো হয়। এর ফলে শুধু উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পড়াশুনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সাম্প্রদায়িকতা, শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ আর শিক্ষা সংকোচনকে ভিত্তি করে প্রণীত এই ‘মজিদ খান শিক্ষানীতি’-র বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে, এই শিক্ষানীতি বাতিলের পক্ষে ছাত্র সংগঠনগুলো একমত পোষণ করে।
এরপর ১৯৮২ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে মজিদ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সারাদেশে গণস্বাক্ষরতা অভিযান শুরু করা হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে এরশাদ সরকার ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুকসহ বেশ কিছু ছাত্র নেতাকে গ্রেফতার করলে তার প্রতিবাদে ৮৩ সালের ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি সারা দেশে ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হয়। সফল এই ধর্মঘটের পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি হাতে নেয়। আর সেদিন ছাত্রদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে এরশাদের হাত রক্তে রঞ্জিত হয় ১০টি তাজা প্রাণের বিনিময়ে।
ছাত্রদের মিছিল হাইকোর্টের গেট এবং কার্জন হল সংলগ্ন এলাকায় কাঁটাতারের সামনে আসলে পুলিশের অতর্কিত হামলার শিকার হয় ছাত্রদের মিছিল। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর রঙিন গরম পানি ছিটায় এবং গুলিবর্ষণ করে। পুলিশ সেদিন জয়নালকে গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি বেয়নেটের মাধ্যমে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। শুধু জয়নাল নয়-ছাত্রদের ওপর পুলিশি তা-বের সময় শিশু একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা দিপালী নামের একটি শিশুও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। সরা দিনব্যাপি গ্রেফতার অভিযান চালিয়ে শত শত ছাত্রকে গ্রেফতার করে হাত-পা ভেঙ্গে ট্রাকে উঠিয়ে নেয় পুলিশ। আর এঘটনার প্রতিবাদে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য পদত্যাগ করেন।
এরশাদ সরকারের এ ছাত্র নিপিড়ণের খবর দেশব্যাপি ছড়িয়ে পড়লে ১৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে কাঞ্চন ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় সেনা ও পুলিশি নির্যাতনে সংখ্যা না জানা আরো কয়েকজন নিহত হয়। সেদিন গ্রেফতার করা হয় কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে। সরকারি হিসাব মতে এক হাজার ৩৩১ জন।
জীবন দিয়ে সেদিন ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার্থে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং স্বৈরাচারী সরকার ও প্রশাসনকে বাধ্য করেছিল এ বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি স্থগিত করতে। গোটা আশির দশকজুড়ে প্রতি বছর এ দিনটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয় এবং এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, বাম প্রগতিশীল ছাত্র ও রাজনৈতিক দলগুলো যার যার অবস্থান থেকে কর্মসূচি দিয়ে দিবসটি পালন করতো এবং তা সংবাদ মাধ্যমগুলো গুরুত্ব দিয়েই প্রচার করতো।
৯০ পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারের পতনের পর দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়। কিন্তু জনগণের আন্দোলন, সংগ্রাম ও আত্মদানের ফসল স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসটি বিলীন হতে থাকে। ১৯৯০-উত্তর ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের গুরুত্ব হারাতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে প্রবল এরশাদ বিরোধী ও সে সময়ের নির্যাতিত সাংবাদিক শফিক রেহমান ৯৩ সালে তার সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের মাধ্যমে দেশে বিশ্ব ভ্যালেন্টাইন দিবসের অবির্ভাব ঘটান। দীর্ঘ ২৩ বছরে এখন এদিবসটি দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে।
২৭০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধবাজ রোমান স¤্রাট ক্লডিয়াসের স্বৈরাচারী নীতির বিরোধীতা করায় সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ভ্যালেন্টাইনের সংগ্রামী চেতনা থেকে আজ সংগ্রামটুকু বাদ দিয়ে কেবল ব্যবসায়িক চটক নিয়ে সা¤্রাজ্যবাদীরা তা নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে।
আবার ফেব্রুয়ারি মাস বাঙ্গালী জাতির জন্য শোকের মাস। এ মাসের প্রতিটি দিনই বাঙ্গালীর স্বাধীকার ও অধিকার আন্দোলনের বিজয় গাঁথা ইতিহাস জড়িত। ফেব্রুয়ারি মাসে বাঙ্গালী আদায় করে নেই তার মায়ের ভাষার অধিকার।
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভ্যালেন্টাইন দিবসকে সামনে রেখে প্রশ্ন রাখতেই হয় কোন চেতনাকে উর্ধ্বে তুলে ধরা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ । গণতন্ত্রের জন্য জনগণের সংগ্রামের চেতনা, দেশ ও স্বাধীনতাকে ভালোবাসার চেতনা, না কি সেই চেতনাকে আড়াল করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রতিষ্ঠিত আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থবাদী ভালোবাসার চেতনা।