সোহা’র জন্য যত ভালবাসা

FB_IMG_1468261407209মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের মধ্য কাউয়ারখোপ। একটি আদর্শ শহুরে গ্রাম। গত ১১ জুলাই সন্ধ্যা থেকে সর্বত্র একটি কথা। জলজ্যান্ত একটি মেধাবী ও নিস্পাপ শিশু মায়া মমতার বন্ধন ছিঁড়ে অকালে চলে যাওয়াটাকে কেউ সহজে মেনে নিতে পারছেননা। মসজিদে, বাজারে, স্কুলে, চায়ের দোকানে, অফিসে, রাস্তাঘাটে সবখানেই একই কথা। তুমি যদি শুকতারার মত চলেই যাবে, তাহলে এত কৃতিত্ব, এত মেধার স্বাক্ষর রাখলে কেন? এত মমতা দেখালে কেন? এত প্রতিভা’র বিকাশ ঘটালে কেন? সবার কাছে এত প্রিয় হয়ে উঠেছিলে কেন? ধরা ছোঁয়ার বাইরে যদি চলে যাবে, তাহলে এত সান্নিধ্যে এসেছিলে কেন? রূপকথার গল্প যদি হবে, হৃদয়ের মনিকোটায় স্থান করে নিলে কেন? ধরনীর তরে অস্তমিত যাবে যদি, এতচিহ্ন রেখে যাবে কেন? এই “কেন” শব্দটির কেউ সদুত্তর দিতে পারছেননা। নিকটাত্মীয়স্বজন, শিক্ষক, সহপাঠী, শুভানূধ্যায়ীদের গগনবিদারী আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। মাতা-পিতার বুকফাঁটা বিলাপে আল্লাহর আরশ যেন কেঁপে উঠছে। বুঝাতে চাইলেও বুঝানো যায়না। কেউ মানতে চায়না, ভুলতে চায়না। চলছে শোকের মাতম। মায়ের মমতাময়ী হৃদয় বিদারক শোকাতুর করুণ ডাকে মানবকুল ছাড়াও পশুপক্ষী, গাছপালাও যেন অঝোর নয়নে কাঁদছে। অপরিণত বয়সে আপনজন হারানোর ব্যাথা সেই বুঝে, যে আপনজন হারিয়েছে। বর্ষার বৃষ্টি আর নয়নের অশ্র“ যেন প্রতিযোগিতা দিয়ে সমানতালে ঝরছে। যেন শোকের এক অভয়রাণ্য। ওহ্ আমার দয়ালু আল্লাহ! গর্ভধারিনী পাগল প্রায় সোহা’র মাকে এ শোক সইবার শক্তি দাও। আর পিতার কাঁধে অপরিণত কন্যার লাশ, তার ওজন কত হবে, তা ধারণা করাও মহা কঠিন কাজ। “সান্তনা” নামক শব্দটি যেন এখন পুরোপুরি অকার্যকর। গ্রামটির যেদিকে তাকাই, সেদিকে শুধু হায় সোহা, হায় সোহা। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই এখন নির্বাক। কিন্তু চিরসত্য হলো, আল্লাহ্ যা করেন, সবই বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন। তাই, যা ঘটেছে, সবই সকলের কল্যানার্থে আল্লাহতায়ালা ঘটিয়েছেন।

হ্যাঁ বলছিলাম, মেহজাবিন বিনতে মান্নান সোহা’র কথা। যে শিশু পৃথিবীর আলো দেখেছিল ২০০৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর। সোহা কক্সবাজার জেলা পরিষদের হিসাবরক্ষক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ও দিলরুবা ওসমানী’র জৈষ্ট্য কন্যা এবং বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ নেতা আলহাজ্ব মনির আহমদ ও বৃহত্তর ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম মাহমুদুল হক ওসমানী’র নাতিনী। ঈদের ছুটির পর গত ১১ জুলাই স্কুল খুললে সোহা বাড়ি থেকে একটু দূরে তার প্রিয় স্কুল কাউয়ারখোপ সরকারী প্রাইমারী স্কুলে যায়। স্কুলে গিয়ে সোহা তার হাতে থাকা কয়েকটি পেয়ারা খেতে থাকলে সহপাঠিরা তাকে “এত পেয়ারা খাচ্ছ কেন” বললে সোহা তার উত্তরে “আজকে পেয়ারা খেয়ে মরে যাব” বলে জানায়। সোহা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে স্কুলের বাইরে ভিজতে থাকলে স্কুলের কর্মচারী ইলক বড়–য়া ধমক দিয়ে “কেন বৃষ্টিতে ভিজতেছ, ভিতরে চলে আস” বললে সোহা বিনয়ের সাথে উত্তর দেয়, “আপনার স্কুলে আর জীবনে আসবনা”। একই সময়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দিলরুবা আকতার গাড়ী যোগে স্কুলের গেইটে এসে নামলে সোহা তাড়াহুড়ো করে গেইটে গিয়ে হেড ম্যাডামের কাছ থেকে ব্যাগ ও টিফিন বক্স নিয়ে স্কুলের অফিস পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। ঐদিন বাড়ী ও স্কুলে সোহা অনেককে তার মনের মধ্যে অজানা এক ভয় তাড়া করছে বলে জানিয়েছিল। তাহলে কি সোহা তার মৃত্যুকে আগেই চিনেছিল? বিকেল ৪ টার পর স্কুল ছুটি হলে সোহা যথারীতি মধ্য কাউয়ারখোপ হাকিম রকিমা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন তার বাড়িতে চলে যায়। বাড়িতে রান্না ঘরে গিয়ে সোহা নিজে নিজে ভাত খেয়ে বাড়ীর অন্যান্য শিশুদের সাথে খেলতে থাকে। বিকেল ৫টার দিকে সোহাকে বাড়িতে না দেখে সবাই খোঁজাখুজি করতে থাকে। সন্ধ্যা ৬ টার দিকে সোহা’র বাড়ির একটু দূরে সোহা’র চাচাত দাদা শফিউল আলমের ছোট্ট পানির কুয়ার পাড়ে সোহা’র সেন্ডেল পাওয়া যায়। তখন অনুমান করে ঐ পঁচা পানির অভিশপ্ত কুয়াতে লোকজন জাল মেরে ও ডুব দিয়ে সাড়ে ৬টার দিকে সোহাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে। আজরাইলবেশী হিংস্র ডাইনী সেই পানির কূয়াটি যেন এখন সবার শত্র“। কিন্তু সেই মরণফাঁদ কূয়ার ধারে সোহা কেন গেল, কিভাবে গেল, কিভাবে কূয়ার পানিতে ডুবল-এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। সোহা’র এ হৃদয় বিদারক ও অবিশ্বাস্য খবর মুহুর্তেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই সোহা’র প্রাণহীন চেহারা একনজর দেখার জন্য নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, ধর্ম-বর্ণ নির্বেশেষে সকলের ঢল নেমেছিল।

মেধাবী সোহা তার স্কুলে শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বরাবরই শীর্ষস্থানে থাকত। জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় পর পর ৩ বছর জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তার শিক্ষকদের ধারনা অনুযায়ী সে এবারও পি.এস.সি এবং প্রাথমিক বৃত্তির ফলাফল খুবই ভাল করতো। অর্থাৎ সোহা যে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে সেখানেই শীর্ষস্থান অধিকার করেছে। সোহা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার ব্যাপারেও খুবই মনযোগী ছিল। কয়েক বৎসর ধরে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, বিগত ৩ বছর ধরে রমজান মাসের রোজা ও নিয়মিত কোরআন তেলওয়াত করতো। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলো কাউয়ারখোপ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির মেধাবী এই মাসুম শিশুটি। ১২ জুলাই পূর্ব কাউয়ারখোপ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ময়দানে স্মরণকালের বিশাল জানাজার মাধ্যমে সবাই অশ্র“সজল নয়নে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সোহাকে চিরবিদায় জানিয়েছেন। সোহা এখন শুধুই ছবি, গল্প আর স্মৃতি। মাতা, পিতা, নিকটাত্মীয়স্বজন, সহপাঠীদের কাছে “সোহা” নামক নিষ্পাপ ছোট্ট শিশুটির হয়ত বেশী প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সোহাকে চিরদিনের জন্য এই পৃথিবী থেকে জান্নাতের মেহমান করে নিয়ে যাওয়াটাকে মহান আল্লাহতায়ালা বেশী পছন্দ করেছেন। এটাই বাস্তবতা, এটাই চিরসত্য। আবেগী মন মানতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত এটাই মানতে হবে। মধ্য কাউয়ারখোপ টুইন্যামুরা নামক কেন্দ্রীয় কবরস্থানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত সোহার কবর জেয়ারতের জন্য প্রতিদিন অসংখ্য সহজ, সরল, শোকাতুর মানুষ দলে দলে যাতায়াত করেন। সোহার মৃত্যুকে মহান আল্লাহতায়ালা শহীদী মৃত্যু হিসাবে মর্যাদা দিন। মহান আল্লাহতায়ালা সোহাকে জান্নাতের বাগানের অংশ করে নিন। সোহা’র আত্মীয়স্বজনকে জান্নাতের সেই সুশোভিত বাগানের গর্বিত বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ করে দিন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই শোক সইবার তৌফিক দিন। ঘুমাও সোহা, শান্তিতে ঘুমাও কেয়ামত পর্যন্ত। মা মনি সোহা’র জন্য নিরন্তর দোয়া ও অজস্র ভালবাসা থাকল। আমিন। ছুম্মা আমিন।

(লেখক: এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ঢাকা)।


শেয়ার করুন