সৈয়দ আশরাফ এখন কী করবেন?

পীর হাবিবুর রহমান1436808634

কী করবেন সৈয়দ আশরাফ? দলের ভেতরে-বাইরে সর্বত্রই একই প্রশ্ন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেয়ার পর সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সৈয়দ আশরাফ। ইফতার মাহফিলসহ বিভিন্ন সামাজিক মিলনমেলায়ও আশরাফই হয়ে উঠেছেন আলোচনার মুখ্য বিষয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আপাদমস্তক একজন নির্লোভ, নিরহঙ্কারী এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুগত সৎ রাজনীতিবিদ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ঈমানি পরীক্ষা দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘাতক চক্রের হাতে শহীদ হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে উঠে আসা তার পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাজনীতিতে এনেছিলেন। ‘৯৬ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। একজন উদার গণতন্ত্রী, ভদ্র-বিনয়ী, সজ্জন মানুষই নন; সততার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়ার মধ্য দিয়ে ওয়ান ইলেভেনকালীন সংকটকালে আরেকবার প্রমাণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক আত্মার। সৈয়দ নজরুলের রক্ত সৈয়দ আশরাফের ধমনীতে। এই রক্ত বিশ্বাসঘাতকতা জানে না। কৌশলের সঙ্গে তিনি সংস্কারপন্থিদের মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে কোনোক্রমে লন্ডন চলে যান এবং তার নেত্রীর প্রতি আনুগত্যের জায়গাটি পরিষ্কার করেন। পরবর্তী সময়ে কাউন্সিলের আগেই দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। দলের সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিলকে সাইডে রেখে সৈয়দ আশরাফকে সামনে নিয়েই দলের জাতীয় কাউন্সিল সম্পন্ন হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলটি ক্ষমতায় আসার পর। সেই সঙ্গে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হন। পরবর্তী কাউন্সিলেও স্বপদে বহাল রাখা হয়। ‘১৪ সালে দল আবার ক্ষমতায় এলে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হিসেবে আবার শপথ নেন। মন্ত্রণালয়, দলীয় কার্যালয়, সংসদে তার উপস্থিতি ছিল অসন্তোষজনক। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে বারবার কথা উঠেছে। একটি গ্র“প সক্রিয় হয়েছে তার বিরুদ্ধে। গণমাধ্যমে বিস্তর লেখালেখি ও সমালোচনা হয়েছে। সেই সময় গণমাধ্যম তার সমালোচনা করলেও এবার তার বিদায়কে ঘিরে সহানুভূতিশীল। আশরাফের এই বিদায়কে সরকারের অন্দর মহলের একটি শক্তির ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে ঘটেছে কিনা তার আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে দফতর হারানোর পর সৈয়দ আশরাফ যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সবাইকে ভাবিয়েছে। তিনি তার এলাকাবাসীর ইফতারে বলেছেন, ‘আমি মন্ত্রী হই বা না হই, রাজনীতি করি বা না করি, হোসেনপুরবাসীর উন্নয়নে আমি সব সময় থাকব। আমি লাভের রাজনীতি করি না। আমার বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানি না করে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। সেই রক্ত আমার শরীরে। এই রক্ত বেইমানি করতে জানে না।’
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তার বেদনার প্রকাশ যেভাবে ঘটেছে তেমনি রাজনীতিতে থাকি আর না থাকি দল ও জাতির জন্য ইঙ্গিতবহ বার্তা দিয়েছে। জানা যায়, এ বক্তব্যের রাতেই বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানা লন্ডন থেকে তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। অন্যদিকে পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আশরাফকে গণভবনে ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে পঁচাত্তরের কালরাতে বাবা-মাসহ পরিবার-পরিজন হারানোর বেদনায় রক্তাক্ত হƒদয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দুই বোন তাদের পিতার আদর্শের পথে অবিচল থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা জাতীয় চার নেতার সন্তানদের রাজনীতিতে টেনে এনেছেন, ধরে রেখেছেন। শহীদ তাজউদ্দীনের পুত্র সোহেল তাজকে রাজনীতিতে এনে শেখ হাসিনা সংসদেই আনেননি; ক্ষমতায় এসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী করে। তিনিও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আত্মমর্যাদার প্রশ্নে অভিমান নিয়ে মন্ত্রিত্বই ছাড়েননি, রাজনীতি থেকেই চলে যান। সেখানে তাজউদ্দীনকন্যা সিমিন হোসেন রিমিকে বঙ্গবন্ধুকন্যা সংসদে আনেন। দলে ঠাঁই দেন। আরেক শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সন্তান মোহাম্মদ নাসিমকে দলে ও সরকারে বারবার নেতৃত্বের আসনে রেখেছেন। আরেক শহীদ এ এইচ এম কামরুজ্জামানের করুণ হত্যাকা-ে শোক বিহ্বল স্ত্রী চাননি সন্তান রাজনীতিতে আসুক। কিন্তু শেখ হাসিনা তার পুত্র খায়রুজ্জামান লিটনকেও রাজনীতিতে এনে প্রতিষ্ঠা করেন, রাজশাহীর মেয়র নির্বাচিত হন। বিশ্বাসঘাতক খুনি মোশতাকের সঙ্গে ধানম-ির ৩২ নম্বরের রক্তাক্ত বাড়ির সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ রেখে যারা শপথ নিয়েছিলেন তাদেরকে বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজের সরকারে ঠাঁই দেননি। কিন্তু শহীদ পরিবারের সন্তানদের দলে ও সরকারে প্রাধান্য দিয়েছেন।
একনেকের বৈঠকে সৈয়দ আশরাফের অনুপস্থিতির ঘটনায় তার দফতর হারানোর নেপথ্যে মন্ত্রিসভার কয়েক সদস্যের কূটচাল ছিল বলে সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যদিও প্রকাশ্যে বলেছেন, বিষয়টি আমরা কয়েকজন সিনিয়র জানতাম। এটা তার সারল্যতার প্রকাশমাত্র। কিন্তু শুরুতে খেলাটি খেলেছেন একজন তারকা রাজনীতিবিদ। আশরাফের অনুপস্থিতিতে একনেকের বৈঠকের শুরুতেই তিনি বলেছিলেন, সে কি ঘুম থেকে উঠেছে? এমনকি আশরাফের জায়গায় স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বলে বিশেষায়িত করে এই মন্ত্রণালয় ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের হাতে অর্পণ করার প্রস্তাবটিও তিনিই করেছিলেন। অর্থমন্ত্রী এমপিদের বরাদ্দের টাকা কাকে দেবেনÑ মন্ত্রীই নেই এই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তাদের জন্য পথটি খুলে দিয়েছিলেন। যদিও আশরাফের অনুপস্থিতিতেই টাকা ছাড় হয়েছে। এখন সর্বত্র আলোচনার বিষয় সৈয়দ আশরাফ আগামীকাল পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে লন্ডন যাচ্ছেন। ফিরেই তিনি তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা খোলাসা করবেন। তিনি কি অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিচ্ছেন? নাকি ওবায়দুল কাদের যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেই পথ ধরেই সত্যি তিনি দলকে সময় দিয়ে নতুন করে সংগঠিত করবেন, নাকি মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পাশাপাশি আগামী কাউন্সিলে দলের দায়িত্ব থেকে বিদায় নেবেন? তবে গণমাধ্যমে মন্ত্রণালয় ও দলে সময় না দেয়ার জন্য যারা তার সমালোচনা করতেন, তারা এখন টকশোতে উদারচিত্তে বলছেন আশরাফ তার সমালোচনার জন্য নিষ্ঠুর প্রতিহিংসার ছোবল দেয়া দূরে থাক, কোনো প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করতেন না। এমনকি রাজনীতিতে তার ভাষা আর দশ জনের মতো ছিল না। ছিল মার্জিত, পরিশীলিত এবং যখন তখন তিনি ফালতু কথা বলতেন না, মিডিয়া কাভারেজের প্রতি তার আগ্রহ ছিল না। যেমন ছিল না মন্ত্রিত্ব ও ক্ষমতা উপভোগ করার চরিত্র। মানবকণ্ঠ


শেয়ার করুন