বিশেষ প্রতিবেদন

সেতু অচল, সাঁকোতে কিছুটা স্বস্তি

pic-ha-29-09-2015হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী, রামু থেকে :
পাড়ে দাঁড়ালে মনে হবে নদীতে নতুন করে সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। নির্মাণ কাজ থেমেছে নদীর মাঝ পথে এসে। কারণ এ সেতুর দক্ষিণাংশে বালুচর সৃষ্টি হয়ে একটু সামনেই প্রবাহিত হচ্ছে পুরো বাঁকখালী নদীর পানি। আপাতত লোকজন পারাপার করার স্বার্থে তৈরী করা হয়েছে দুটি সাঁকু। তবে আদতে তা নয়! সেতুর সংযোগ সড়ক ভেঙে যাওয়ায় এমন বিভ্রম।
কক্সবাজারের রামু উপজেলায় গেল জুন মাসের ভয়াবহ বন্যায় বাঁকখালী নদীর প্রবল ¯্রােতে ঐতিহাসিক স¤্রাট শাহ সূজা সড়ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে গর্জনিয়া সেতু। তাৎক্ষণিক নেওয়া হয়নি প্রয়োজনিয় উদ্যোগ। নদীভাঙন অব্যাহত থাকায় নদীগর্ভে এ পর্যন্ত বিলীন হয়েছে প্রায় ৪০০ ফুট সড়ক। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে নাইক্ষ্যংছড়ি-গর্জনিয়া-বাইশারী সড়কে যানবাহন চলাচল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গর্জনিয়া সেতু অচল থাকায় সদ্য বিদায় নেওয়া ঈদুল আযহা সেভাবে পালিত হয়নি। অকেজো সেতু আর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বন্যা যেন কেড়ে নিয়েছে বৃহত্তর গর্জনিয়াবাসীর ঈদ আনন্দ। চলতি বছরের ঈদুল ফিতরও উদযাপিত হয়েছে একই কায়দায়। ২০১২ সালেও সেতুর দক্ষিণাংশের এপ্রোচসহ সড়ক নদীগর্ভে তলীয়ে যাওয়ায় ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা কেটেছে নিরানন্দে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে এলজিইডি প্রায় তিন কোটি টাকা খরচ করে গর্জনিয়া-কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের সংযোগস্থল বাঁকখালীর নদীর ওপর ১৬০ দশমিক ১৭৫ মিটার দীর্ঘ গর্জনিয়া সেতুটি নির্মাণ করে। বর্তমানে সেতুটি রক্ষায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা জানতে চাইলে এলজিইডি রামু উপজেলা প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ দত্ত জানান, সেতু রক্ষার জন্য গত বছর নদীর তলদেশ খনন করে ¯্রােতের গতিপথ পরিবর্তন করা হয়েছিল। পরে পলি পড়ে ওই অংশ আবার ভরাট হয়ে যায়। বন্যায় বিলীন হওয়া সেতুর সংযোগ সংস্কারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ এলে সংস্কারকাজে হাত দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তৈয়ব উল্লাহ চৌধুরী বলেন, শীঘ্রই স¤্রাট শাহ সূজা সড়কের উন্নয়ন কাজ শুরু হবে। এ কাজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে। সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল ও উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজুল আলমের সহযোগিতায় গর্জনিয়া সেতু পুনরায় চালু করে, নদীর গতিপথ পরিবর্তনের জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সম্ভব হলে এ কাজটিও সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই শুরু হবে।
এদিকে গর্জনিয়া ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান নুরুল আলম জানান, গেল জুন ও জুলাই মাসের কয়েক দফা বন্যায় এলাকার লোকজন সহায়-সম্ভল হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ আবার ঘরবাড়িও হারিয়েছে। নগদ অর্থ না থাকায় এবার ঈদে বাবা-মায়েরা শিশু ছেলে-মেয়েদের হাতে নতুন জামা-কাপড় উপহার দিতে পারেনি। তার ওপর গর্জনিয়া সেতু অচল থাকায় এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারে স্থবির।
একই পরিষদের নারী ইউপি সদস্য (৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ড) আয়েশা খানম চৌধুরী জানান, এতদঅঞ্চলের হাজার হাজার বানভাসির মনে এবার ঈদের আনন্দ ছিল না। তাদের ঘরে খাবার নেই। প্রায় দুই মাস ধরে অনেকে কাজও খুঁজে পাচ্ছে না। ভাঙা ঘরবাড়ি মেরামত আর নতুন আশ্রয়ের সন্ধান করতেই গলদঘর্ম তারা। ধারদেনা, দাদননির্ভর (দ্রব্যাদির অগ্রিম মূল্য) জীবনে তাই ঈদের মতো বড় উৎসবের আনন্দ এ বছর অধরাই ছিল তাদের কাছে। এখন দুমুঠো ভাত জোগাড়ই দায়। তার উপর ঈদে নতুন পোশাক না পাওয়ায় সন্তানদের মলিন মুখ কষ্ট দিলেও নিরুপায় তারা।
বাইশারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল হক জানান, গেল তিনমাস ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি-গর্জনিয়া-বাইশারী সড়ক ও ঈদগাঁও-ঈদগড়-বাইশারী সড়কে সরাসরি যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় ইউনিয়নের লোকজন দ্বীপ অঞ্চলের ন্যায় বসবাস শুরু করেছে। নিদারুণ কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী মহল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় সঠিক সময়ে ত্রাণ বিতরণ করাও সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন কার্যক্রম। এসব থেকে পরিত্রানের জন্য জরুরী ভিত্তিতে গর্জনিয়া সেতু সচল করার দাবী জানান তিনি।
নদী পারাপারে প্রাণহানি : গর্জনিয়া সেতু সচল না থাকার পাশাপাশি বাঁকখালী নদীর পানি বিপদসীমার উপরে অতিবাহিত হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে এখানকার লক্ষাধিক বাসিন্দাদের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল ডিঙি নৌকা। কিন্তু নৌকাযোগে নদী পারাপার হতে গিয়ে ঘটেছে নানান দুর্ঘটনা। ক্ষতি হয়েছে আর্থিক এবং জানমালের। এ নিয়ে আতঙ্ক বেড়ে যায় গর্জনিয়া উচ্চবিদ্যালয় ও গর্জনিয়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার হাজারো শিক্ষার্থী এবং লক্ষাধিক মানুষের অন্তরে। শেষ পর্যন্ত নৌকাডুবিতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। গত ১৯ আগষ্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে ওই পয়েন্টে নৌকাডুবির ঘটনায় গর্জনিয়ার পূর্ব বোমাংখিল গ্রামের জাফর আলমের ছেলে নুরুল আমিন ওরফে মাওলানা এখলাস (২৬) ও ক্যাজরবিল গ্রামের হাসু নাথের ছেলে আশীষ কুমার (২৭) নিখোঁজ হন। এসময় উত্তাল নদীতে সাঁতরিয়ে নদীর কূল ধরেন গর্জনিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহরান চৌধুরী মারুফ ও নৌকার মাঝি হাফেজ আহমদ। ঘটনার তের দিন পর রামুর মহিষেরকুম জাদি সংলগ্ল এলাকা থেকে আশিষ কুমারের লাশ উদ্ধার করা হলেও এখলাসের সন্ধান বা মরদেহের হদিস মেলেনি।
সাঁকোতে কিছুটা স্বস্তি: নদীপারাপারে একাধিক নৌকাডুবির ঘটনায় মানুষ যখন আতঙ্কগ্রস্থ ছিল ঠিক তখনই অসম্ভবকে সম্ভব করে, একদল উৎসাহি ব্যক্তি গর্জনিয়া সেতু পয়েন্টে নিজেদের উদ্যোগে একটি গাছের সাঁকু নির্মাণ করে দুর্ভোগ লাঘব করেন। এতে করে ঝুঁকি কমে যাওয়ার পাশাপাশি আর্থিকভাবেও মানুষের সাশ্রয় হচ্ছিল। কিন্তু এ নিয়ে টাকা উত্তোলের ঘটনায় নানান বিতর্ক জন্ম দিলে এক সপ্তাহ পর গর্জনিয়া ইউনিয়ন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী বিনামূল্যে পরাপারের জন্য আরো একটি সাঁকু নির্মাণের মহতি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাদের এ কাজে সার্বিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়ান কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব সাইমুম সরওয়ার কমল।
অবশেষে নানান বাঁধা অতিক্রম করে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের চেষ্টার ফসল হিসাবে ঈদুল আযহার আগেই তৈরী হয় দৃষ্টিনন্দন যুকিমুক্ত বড় সাঁকু। সাঁকু তৈরীর উদ্যোক্তা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান ও যুবলীগনেতা হাফেজ আহমদ জানিয়েছেন স্থানীয় সাংসদ, গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান সহ সকলের সহযোগিতায় তৈরীকৃত দৃষ্টিনন্দন সাঁকু দিয়ে এখন মোটরসাইকেলও চলছে। উভয় সাঁকু দিয়ে লোকজন এখন বিনামূল্যে নির্বিঘেœ চলাচল করছে। এতে করে মানুষের মনে কিছুটা স্বস্থিভাব এসেছে বলে তারা জানান।


শেয়ার করুন