সিসির শাসনে নিন্দা কুড়াচ্ছে বিশ্বখ্যাত আল-আজহার

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

মিশরীয় স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি যখন চলতি বছরের শুরুর দিকে ‘ইসলামের ভবিষ্যৎ’ নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে চাইলেন তখন অবধারিতভাবে ভেন্যু হিসেবে চলে এলো কায়রোর বিশ্বখ্যাত ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।

১০০০ বছরের বেশি পুরনো এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে অনেকেই ভ্যাটিকানের মত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন এবং দীর্ঘদিন যাবৎ বিশ্বব্যাপী সুন্নী মুসলিমদের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আল-আজহার ক্রমেই রাজনীতিকরণের শিকার হয়েছে। সিসির শাসনে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো যার কড়া সমালোচনা করছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিতর্কিত নীতির জালে জড়িয়ে পড়ছেন। সারবিশ্বের অনেক মুসলিম নেতাই মিশর সরকারের সমালোচনা করছেন আর বহুযুগের শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠানটির ধর্মীয় মর্যাদায় ক্ষয় ধরেছে।

মিশরের রাজনীতি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করা এই অধ্যাপক আরো বলেন, ‘এতে পরিস্থিতির মেরুকরণ ঘটেছে। আল-আজহারের সুনাম এখনো কিছু লোকের কাছে মজবুত তবে অন্যদের কাছে তা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে।’

মিশরজুড়ে আল-আজহারের অধীনস্ত কলেজ, প্রাথমিক বিদ্যালয় আর হাইস্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ লাখেরও বেশি। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব বিভাগগুলোতে সারাবিশ্ব থেকেই হাজার হাজার শিক্ষার্থী পড়তে আসেন এখানকার শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদদের অধীনের অধ্যয়নের জন্য। এখানে স্নাতক হওয়ার পরে শিক্ষার্থীরা ইমাম অথবা শিক্ষাবিদ হয়ে নিজ দেশে ফিরে যায়।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ধর্মীয় বিষয়ে  যেসব ফতোয়া দিয়েছে তা সুন্নী মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে।

আল-আজহার বিশ্বদ্যিালয়ের সাথে মিশর সরকারের সম্পর্ক বহুদিনের পুরনো হলেও সাম্প্রতিক সময়েই কেবল এটি এতোটা রাজনীতিকরণের শিকার হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিসিকে সমর্থন করার কারণে এখন অনেক কম সংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী এখানে পড়তে আসছেন। তুরস্ক, মরক্কো, মালয়েশিয়ার মত মুসলিম দেশগুলোর জনগণ সিসি সরকারের তীব্র বিরোধিতা করছে এবং তাকে সমর্থন দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানটির ক্রমবর্ধমান সমালোচনা হচ্ছে।

এর মধ্যে তুরস্কের মধ্যপন্থী ইসলামঘেঁষা সরকার সম্ভবত সিসির সবচেয়ে কড়া আন্তর্জাতিক সমালোচক। গত বছর তুরস্ক ঘোষণা করেছে যে দেশটি নিজস্ব আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। অনেকেই ধারণা করছেন যে তুরস্ক আল-আজহারের প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে যাচ্ছে।

২০১৩ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেই সিসি ব্রাদারহুড এবং তার নীতির সমালোচকদের ওপর ভয়াবহ দমনপীড়ন চালাতে শুরু করেন। এ সময় শত শত ব্রাদারহুড কর্মীকে হত্যা করা হয়। সরকার হাজার হাজার মসজিদ বন্ধ করে দেয়। নিষিদ্ধ করা বহু গ্রন্থ এবং গণমাধ্যমের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।

সিসির সরকার আইন পাস করে জুমার নামাজের খুতবায় কি পাঠ করা হবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং শুধু সরকারি ইমামদের খুতবা দেয়ার আইন প্রয়োগ করেছে। অন্যান্য ধর্মীয় পরিবর্তনের পাশাপাশি আল-আজহারে কয়েক শতাব্দী ধরে চলা পাঠ্যসূচিতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে।

যেমন আল-আজহারের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি আলি গুমা সিসির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করাকে মহানবীর (সা.) প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সাথে তুলনা করেছেন (নাউজুবিল্লাহ)। তিনি বিরোধীদের দমনেরও আহ্বান জানিয়েছেন। সম্প্রতি আল আজহারের এক নেতা সিসি এবং তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মুসা এবং তার ভাই অ্যারনের সাথে তুলনা করেছেন।

‘তাদের প্রপাগান্ডা আর ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য সুষ্পষ্ট। গড়পরতা মুসলিমের কাছে এটা বাড়াবাড়ি। এটা কেতাবের কথা নয়, এটা নেহায়েতই প্রপাগান্ডা,’ বলছিলেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর এমাদ শাহীন।

গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে মিশর সরকার সম্প্রতি তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে।

সিসির সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করায় গত দুই বছরে আল-আজহারের হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এখানকার ছাত্রদের বেশিরভাগই ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সমর্থক এবং বর্তমান সরকারের বিরোধিতা করে যাচ্ছে। বিক্ষোভে অংশ নেয়ার অভিযোগে অন্তত ১৩০ ছাত্রকে বহিস্কার করা হয়েছে।

মিশরের প্রয়াত স্বৈরশাসক গামাল আবদেল নাসেরের শাসনকালে (১৯৫২-১৯৭০) আল-আজহারকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। কয়েক দশক ধরেই এটি সরকারী অর্থায়নে চলে এবং এর প্রধান বা গ্র্যান্ড ইমামকে শাসকই নিয়োগ দেয়।

বর্তমান গ্র্যান্ড ইমাম শেখ আহমেদ আল-তায়েব পতিত স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের দলের সদস্য ছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আল-আজহারের অনেক শিক্ষাবিদই সিসির দমননীতিকে সমর্থন করছেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারকে সমর্থন দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

‘একটি স্বৈরশাসকের অধীনে আপনার স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই’ বলছিলেন জন এসপোসিতো।

সিসির নীতির অধীনে আল-আজহার তার ধর্মীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। তুরস্ক আল-আজহারের প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামিক ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করলেও তা কঠিন হবে বৈকি।

কায়রোর আমেরিকান ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক এমাদ শাহীন যেমনটা বলছেন, ‘আপনি এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে চাইছেন যা হবে (মুসলমানদের) অক্সফোর্ড কিংবা হার্ভার্ডের সমতুল্য।’

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসে প্রকাশিত  নিবন্ধ, ভাষান্তর ফাতিমা ফেরদৌসী আশা


শেয়ার করুন