সিরিজ অপরাধে পুলিশ

পাঁচ মাসে সহস্রাধিক অভিযুক্ত, পুলিশ সুপার ও থানায় থানায় সতর্কবার্তা

wsqqqসিটিএন ডেস্ক:

গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার রাজিবুল হাসান ১৭ বছরের তরুণীকে অপহরণ করে নিজের বাসায় দুই মাস বন্দী করে রাখেন। তরুণীর পরিবার কাফরুল থানায় মামলা করলে র‌্যাব-৪-এর সহায়তায় এপ্রিলে তরুণীকে উদ্ধার করা হয়।

২১ জুন ফেনী সদরের স্পেশাল ব্রাঞ্চের এএসআই মাহফুজুর রহমান প্রায় ৭ লাখ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন, এএসআইর কাছে পাওয়া ইয়াবার বাজার মূল্য ২৭ কোটি টাকা। মাহফুজের তথ্য অনুযায়ী কক্সবাজারের গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তাসহ আরও ১০ জনকে ইয়াবা ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ডিআইজি অফিস প্রমাণ পায়। চাঁদাবাজির অভিযোগে পল্লবী থানার ওসি ও দারোগার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। একজন ব্যবসায়ীকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে গোয়েন্দা পুলিশের বিরুদ্ধে। খিলগাঁওয়ে সাবেক স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। অপহরণ, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা; ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি এবং নারী কেলেঙ্কারির মতো ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে পুলিশ। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাদের দায়িত্ব, তারাই এখন মানুষের নিরাপত্তাভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থের জন্য সাজানো মামলায় যাকে-তাকে হয়রানি ও থানায় এনে নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে। সাজানো মামলার আসামি হয়ে অনেকের জীবন এখন দুর্বিষহ। সাম্প্রতিককালে একের পর এক সিরিজ অপরাধে পুলিশ জড়িয়ে পড়ায় মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধে পুলিশের সংশ্লিষ্টতার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় পুলিশ প্রশাসনকেও ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে পুলিশের কাছ থেকেই পুলিশের ঘুষ আদায়ের ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর পুলিশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) উপকমিশনার (উত্তর) জিল্লুর রহমানের ৭৭ লাখ টাকা ঘুষ আদায়ের ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল। জানা গেছে, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) ২৩০ সদস্যের কাছ থেকে ৭৭ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছিল জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে। জানুয়ারি মাসে এ টাকা উত্তোলন করে তিন পুলিশ সদস্য ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে যৌথ হিসাবে ১৭ লাখ এবং বাকি ৬০ লাখ টাকা জিল্লুর রহমানের কাছে ছিল। পদোন্নতিতে বিলম্ব হওয়ায় উৎকোচ দেওয়া পুলিশের সদস্যদের মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের বিষয়টি পুলিশের সদর দফতর জানতে পায়। এরপরই নগর পুলিশের পক্ষ থেকে গত ১৩ জুন তদন্ত এবং ১৭ জুন সদর দফতর তদন্ত কমিটি গঠন করে। টাকা উত্তোলনের ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় ২৯ জুন সংশ্লিষ্ট তিন এসআইসহ ১০ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর তদন্ত কমিটির কাছে নিজের কাছে ৬০ লাখ টাকা রয়েছে স্বীকার করলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ১ জুলাই নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) জিল্লুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিলেট রেঞ্জে পাঠানো হয়। এ অবস্থায় ফৌজদারি অপরাধে না জড়ানো ও ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার না করার ব্যাপারে সারা দেশের পুলিশের সব ইউনিটকে সতর্ক করে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারদের কাছে পাঠানো ওই বার্তায় পুলিশ সদস্যরা যেন কোনো অপকর্মে লিপ্ত হতে না পারেন, সে জন্য নিয়মিত মনিটরিংয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানিয়েছে।

ডিএমপি কমিশনারও একইভাবে সতর্কবার্তা দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক এবং বিশেষ দুটি এলাকার বিবেচনায় প্রাইজ পোস্টিং পাওয়া পুলিশ সদস্যদের অধিকাংশই এসব অপরাধে জড়িত। দলীয় পরিচয় থাকায় এরা পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদেরও ধার ধারেন না। অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না তাদের বিরুদ্ধে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের কতিপয় সদস্য অপরাধীর কায়দায় সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় গোটা বাহিনীর ইমেজ সংকটের মধ্যে পড়বে। পুলিশের প্রতি মানুষ আস্থা হারাবে; যা পুনরুদ্ধার করা পুলিশের পক্ষে কঠিন হবে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এস এম শাহজাহান বলেন, পুলিশকে নিজেদের মতো করে কাজ করতে দিতে হবে। দলীয়করণের কারণে অপরাধের বেশকিছু ঘটনা ঘটছে, যা পুলিশের কাছ থেকে কেউ আশা করে না।

পুলিশ সদর দফতরের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৪ সালে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৪ হাজার ৪০০ জন পুলিশ সদস্যকে লঘু শাস্তি দেওয়া হয়। একই সময় গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে ৭৬২ জনকে। এদের মধ্যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ৮০ জনকে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ মে পর্যন্ত লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে ৯৫৫ জনকে। গুরুদণ্ড হয়েছে ৪৫ জনের, চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ১২ জনকে। এ ছাড়া অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে নয়জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।গত পাঁচ বছরে ৬৭ হাজার ৮২০ জন পুলিশ কর্মী ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে; যা প্রতি বছর গড়ে ১৩ হাজার ৫৬৪ জন। এতে দেখা যায়, কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক (এসআই) পর্যন্ত পুলিশ সদস্যরা অপরাধে জড়াচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। তবে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) থেকে উচ্চপদের কর্মকর্তাদের এ ধরনের অপরাধে জড়ানোর হার কম। সূত্র জানায়, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যন্ত ৬৩ হাজার ৩৪৯ জনকে লঘুদণ্ড, ৩ হাজার ৫৯০ জনকে গুরুদণ্ড, ৪৬১ জনকে বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত ও ১২৩ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬৭ হাজার ৫২৩ জন কনস্টেবল থেকে এসআইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একই সময়ে ২৩৪ জন পুলিশ পরিদর্শকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় পুলিশ সদর দফতর। এর মধ্যে ২০৭ জনকে লঘুদণ্ড ও ২৭ জনকে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ সময় ৬৩ জন এএসপি থেকে উপরের স্তরের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ জনকে লঘুদণ্ড, ১২ জনকে গুরুদণ্ড, একজনকে বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত ও তিন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।


শেয়ার করুন