সাধারণ মানুষ মুক্তি চায়

সাধারণ মানুষ মুক্তি চায়দ্য রিপোর্ট : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে স্বাভাবিকভাবে চলছে না দেশ। নতুন বছরের প্রথমেই (৪ ও ৫ জানুয়ারি) সরকারের অবরোধে পড়ে দেশবাসী। এরপর শুরু হয় সরকারবিরোধী জোটের অবরোধ। সরকারপক্ষ ও বিরোধী জোটগুলোর অনমনীয়তায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ।

অসহনীয় এই অবস্থা থেকে মুক্তি চায় সকল স্তরের মানুষ। কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব? এই প্রশ্ন এখন সবার মনে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর আজিমপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সাধারণ মানুষের মতামত জানতে চাইলে তারা অস্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কথাই বার বার বলেছেন। পাশাপাশি ঢাকা ও ঢাকার বাইরের তিনজন বাসযাত্রীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হল—

ঘটনা : ১

রাজধানীর মিরপুর থেকে বৃহস্পতিবার বিকেলে বেস্টওয়ে পরিবহনে মতিঝিল আসছিলেন হাসান শরীফ। বাসের ভেতরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘দিনব্যাপী রোদ থাকায় আবহাওয়া মোটামুটি গরম। কিন্তু বাসের কেউই দরজা-জানালা খুলতে দেননি। সবার মধ্যেই ভয়, কখন জানি ককটেল কিংবা পেট্রোলবোমার আক্রমণ হয়।’

ঘটনা : ২

এ্যাডভোকেট আরিফ খান অবরোধের মধ্যেও পেশাগত কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। গত রাত ১২টার দিকে বাসে উঠে ঢাকায় পৌঁছান ভোর পাচঁটায়। ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে কোনোদিন এত দ্রুত গতির গাড়িতে চড়িনি। কখন আক্রমণ হয় এই ভয়ে ড্রাইভার যেভাবে গাড়ি চালিয়েছে তা আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে।’

ঘটনা : ৩

সাংবাদিক আমির শওকত ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যশোর যাওয়ার পথের অভিজ্ঞতার কথা বলেন, ‘গুলিস্তান (ঢাকা) থেকে ইলিশ পরিবহনে উঠে দেখি গাড়ির সব জানালা বন্ধ। খুলতে গেলেই সুপারভাইজার অনুরোধ করেন, ‘ভাই কখন যে কে বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় ঠিক নেই। অতএব জানালা বন্ধ রাখতে হবে।’ এ নিয়ে বাসভর্তি মানুষের মধ্যে চাপা আতঙ্ক।’

তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা পার হয়েও একই অবস্থা। আতঙ্ক তো আছেই, এর সঙ্গে যোগ হয় পরিবহন সঙ্কট। ভেঙে ভেঙে অনেক কষ্টে বাড়িতে পৌঁছাতে পেরেছি।’

সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন স্পট

সকাল ১১টা ৩০ মিনিট

রাজধানীর আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে ১৩ নম্বর বাসের অপেক্ষা করছিলেন সালমা বেগম। তিনি যাবেন হাটখোলায়। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাস এসেছে। কিন্তু বাস হাটখোলায় যাবে না। আজিমপুর থেকে ঘুরে আবার মোহাম্মদপুর চলে যাবে। কারণ হরতাল-অবরোধে লম্বা ট্রিপ বন্ধ।

ক্ষুব্ধ এই অসহায় যাত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কী করার আছে? রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতা নিয়ে খেলে। সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হয় সেই খবর রাখার দায়বদ্ধতা তাদের নেই। সরকারে থাকলে কি জনগণের দরকার হয়? আমরা বন্দী, আমাদের মুক্তি দিবে কেন?’

দুপুর ১২টা : রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিপণিবিতান নিউমার্কেট মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের চায়ের দোকানে রাজনৈতিক আলোচনা চলছিল। তিনজনের দু’জনই খালেদা জিয়াকে নিজের কার্যালয়ে আটকে রাখাকে সমর্থন করতে পারছেন না। অন্যজন দুই সতীর্থের যুক্তি মেনে নিলেও হরতাল-অবরোধে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার চরমবিরোধী। তিনজনের বাইরে থাকা আরেকজন বলে উঠলেন, ‘সভা-সমাবেশ করতে না দিলে দল (বিএনপি) কী করবে?’

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তাদের নাম-পরিচয় জানতে চাইলে, তাদের উত্তর— ‘সময় খারাপ ভাই। কে কার পরিচয় নেয় কওয়া যায় না। তাই সব সময় পরিচয় দেওন যায় না। সব কথাও কওন যায় না।’ এরপরই ভেঙে গেল আড্ডা।

দুপুর সাড়ে ১২টা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরে কথা হচ্ছিল লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্র শামসুল ইসলামের সঙ্গে। রাজনীতি সচেতন এই ছাত্রের অভিমত, ‘সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করার মতো রাজনৈতিক স্তরে এখনো আমাদের রাজনীতিবিদরা পৌঁছাতে পারেননি। কারণ যে দু’টি পরিবার পালাক্রমে দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদের প্রিয়জনদের রাজনৈতিক কারণে হারিয়ে দেশের ওপর নিজেদের রাজতান্ত্রিক অধিকার আছে বলে মনে করছেন। এই দায় শুধু তাদের নয়, আমরা সাধারণ মানুষও দায়ী তাদের নির্বাচিত করার জন্য। কিন্তু এর বাইরেও বড় একটি সমর্থকগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এ বাস্তবতা সামনের দিনে দেখা যাবে। মানুষ মুক্তি পাবে, সেই সময় আসছে।’

দুপুর ০১টা ১৫ মিনিট : মতিঝিলের ব্যাংকপাড়ার একটি হোটেলে দুপুরের খাবারের ফাঁকে কথা বলছিলেন দু’জন। দুই ব্যবসায়ী নিজেদের খারাপ অবস্থার চেয়ে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অবস্থার প্রতি মনোযোগী।

প্রথমজন বলছিলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা যাই হোক না কেন, খাওয়া-পরার তো সমস্যা নেই। যারা দিন রোজগার করে তাদের অবস্থা খুব খারাপ।’ দ্বিতীয়জনের অভিমত, ‘মানুষের আগের মতো আর রাজনীতির প্রতি ঝোঁক নাই। নেতারা যে জনগণকে নিয়ে খেলে, সেটা মানুষ বুঝে গেছে। মানুষকে আর বন্দী করে রাখা যাবে না। সবাই মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী।’

দুপুর ০১টা ৪০ মিনিট : রাজধানীর জিরো পয়েন্টে কথা হয় সুপ্রভাত পরিবহনের চালক মো. হাবিবের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় জেনে মনের কিছুটা ক্ষোভ যেন ঝেড়ে নিলেন তিনি। বললেন, ‘এই অবস্থা থেইক্কা মুক্তি চাই, মুক্তি। ভাই কী আর করমু, সরকার আর বিরোধী দল কেউই তো আমগর কথা ভাবে না। সকালে গাড়ি নিয়া বাইর অইছি। ভয় লাগে, কখন জানি পেট্রোলডা ঘাড়ে আইসা পড়ে। কী আর করমু, বউ-পোলাপান তো ঘরে আছে। ঘরে বইসা আর কয়দিন খামু।’

দুপুর ০২টা ২০ মিনিট : সংবাদকর্মী সায়েম সাবু তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন, ‘তিন বন্ধু মিলে কাল (গত) মধ্য রাতে বের হলাম। বাংলামোটর থেকে মিরপুর পর্যন্ত একজন পুলিশও চোখে পড়ল না। বিরোধী দলকে পাহারা দিয়ে ক্লান্ত পুলিশ। জনগণকে পাহারা দিবে কখন? অবশ্য পুলিশ থাকলেও পাহারার বদলে হয়রানিই বেশী হয়। মানুষের মুক্তি কবে আসবে?’

দুই সপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে অবরোধ ও হরতালে নাজেহাল দেশবাসীকে সরকার ও আওয়ামী লীগ থেকে বার বার আশ্বাস দেওয়া হলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকা মানুষের প্রশ্ন— কবে মুক্তি মিলবে? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?


শেয়ার করুন