সাগর পথে ইয়াবা পাচার : ১ সপ্তাহে শত কোটি টাকার ইয়াবা উদ্ধার

ইয়াবাyaba-ctnশফিক আজাদ, উখিয়া প্রতিনিধি ॥

বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ সীমান্ত জনপদ কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ইয়াবার নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এর প্রবেশ ও ব্যবহার কোন ক্রমেই ঠেকানো যাচ্ছে না। ইয়াবার প্রবেশ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। জেলার সীমান্ত জনপদ গুলো দিয়ে বানের পানি মত ঢুকছে মরণ নেশা ইয়াবা। স্থল সীমান্তের পাশাপাশি এখন জলসীমা দিয়েও এসব ইয়াবা ঢুকছে প্রতিনিয়ত।
গত বৃহস্পতিবার (৫ ফের্রুয়ারী) মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে আসা ৮৩ কোটি টাকা মূল্যের ১৫ লাখ পিস ইয়াবার বিশাল চালান চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে উদ্ধার করেছে নৌবাহিনী। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে ইয়াবার সর্ববৃহৎ চালান আটকের ঘটনা। একইদিন টেকনাফের হ্নীলায় বিজিবি-৪২ পরিত্যক্ত অবস্থায় ২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা মূল্যের ৭০ হাজার পিস পরিত্যক্ত ইয়াবা জব্দ করেছে।
সূত্রে জানা গেছে, দেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে ঘাতক ইয়াবা। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী তরুণ-তরুণীই শুধু নয়, ব্যবসায়ী বা চাকরিজীবীদের একাংশও এখন ইয়াবায় আসক্ত। রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ডাক্তার-প্রকৌশলী ও শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়ছেন ইয়াবা সেবনে। সহজলভ্য হওয়ায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা। ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসনে উদ্বিগ্ন পরিবার তথা সমাজ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও বন্ধ করতে পারছেন না জীবনবিধ্বংসী ইয়াবা ব্যবসা। এসব ইয়াবা ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর হাতিয়ে নিচ্ছে শত কোটি টাকা। চিহ্নিত অপরাধীই শুধু নয়Ñপুলিশ, রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিরা জড়িয়ে পড়ছেন এই মরণ নেশার বাণিজ্যে। এসব ইয়াবার অধিকাংশই আসে মিয়ানমার থেকে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় রয়েছে ইয়াবার বেশ কিছু কারখানা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শুধু বাংলাদেশের চাহিদার কথা বিবেচনা করে মিয়ানমারে স্থাপিত হয়েছে ৭টি ইয়াবা কারখানা। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় মাদক চোরাকারবারি সিন্ডিকেট মিয়ানমারের ওয়া আর্মি নামের সংগঠনের তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে এসব ইয়াবা। প্রতিদিন এ ৭টি কারখানায় ৫ লাখেরও বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট উৎপাদন করা হচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্ত গলে চোরাইপথে এসব ইয়াবা আসছে টেকনাফে। সেখান থেকে আসছে কক্সবাজারে। আর এসব চালান সংগ্রহ করছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়াসহ পাশের এলাকার কিছু প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী। তারাই রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে লাখ লাখ পিস ইয়াবা। আবার কিছু কিছু বড় চালান গভীর সাগরপথে যাচ্ছে চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্নস্থানে।
কক্সবাজারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাদকের ধরন ও চাহিদারও পরিবর্তন ঘটছে। ’৮০র দশকের শুরুতে দেশে হেরোইন এবং পরে ’৮০র দশকের শেষদিকে ফেনসিডিল ছড়িয়ে পড়ে মাদকরাজ্যে। ’৯০ দশকের শেষে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম ধরা পড়লেও তখন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখন সেই ইয়াবায়ই ভাসছে গোটা দেশ। কী পরিমাণ ইয়াবা দেশে ব্যবহার হচ্ছে, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে না থাকলেও তাদের ধারণা, প্রতিদিন ১০ লাখের বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট ব্যবহার করছেন আসক্তরা।
জানা গেছে, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট সহ নানাস্থানে ১ হাজারের বেশি ইয়াবা বিক্রেতা রয়েছেন। প্রতিদিন সারা দেশে লাখের বেশি ইয়াবার চাহিদা রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বিপণিবিতান, জমজমাট এলাকাসহ বিভিন্ন রেস্টুরেন্টকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।
মিয়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবা ট্যাবলেট সীমান্তবর্তী কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার অন্তত ৪২টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে প্রবেশ করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ বিভিন্ন প্রশাসন এ প্রবেশপথগুলো চিহ্নিত করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ইয়াবার খুচরা ব্যবসায়ীরা মাঝেমধ্যে গ্রেফতার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছেন মূল হোতারা। এতে করে ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবা ব্যবসা। বানের পানির মতো দেশে ঢুকছে ইয়াবার চালান। আর যাঁরা গ্রেফতার হচ্ছেন, তাঁদেরও আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আইনের ফাঁক গলে তাঁরা বেরিয়ে আসছেন কারাগার থেকে। আবার ফিরে যাচ্ছেন তাঁদের ইয়াবা ব্যবসায়। ব্যবসার টাকার ভাগ শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত যায়।
ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের অসাধু কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ। সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৭৬৪ ইয়াবা ব্যবসায়ীর নামের তালিকা যুক্ত করা হয়েছে। সূত্রমতে, ওই তালিকায় একজন সংসদ সদস্য সহ টেকনাফ পৌরসভার ২৫১ জনের নাম রয়েছে। এছাড়া ওই তালিকায় স্থান পেয়েছে মহেশখালী উপজেলার ৬ ও বান্দরবান জেলার ২৯ জনের নাম। একইসঙ্গে মিয়ানমারের উচ্চপর্যায়ের ৩৬ ইয়াবা গডফাদারের নাম রয়েছে। আলাদা করে রয়েছে টেকনাফের আলোচিত ৭ প্রভাবশালী এবং ৭ পুলিশ কর্মকর্তার নাম। তবে টেকনাফ উপজেলার আরও দু’শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম ওই তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে বলে জানা গেছে।
এদিকে বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, গোয়েন্দা পুলিশ, র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে শুরু করে দেশের সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইয়াবা উদ্ধারে তৎপর থাকলেও এখনও অধরাই রয়ে গেছেন তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা গডফাদাররা। টেকনাফসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাসে লাখ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার হচ্ছে, মামলাও হচ্ছে। কিন্তু মূল হোতারা গ্রেফতার হচ্ছেন না। বিজিবির দাবি, তাঁরা হাতেনাতে ইয়াবা পাচারকারী ও মূল হোতাদের ধরে মামলা দিয়ে থাকে। কিন্তু এ মামলার তদন্তভার থাকে পুলিশের হাতে। পুলিশ বেশিরভাগ মামলা থেকে আসামিদের নাম বাদ দেয়। এতে তাদের করার কিছু থাকে না। এদিকে পুলিশের দাবি, মামলার এজাহারের দুর্বলতা ও উপযুক্ত সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে পুলিশ কাউকে অভিযুক্ত করতে পারে না। ফলে অনেক মামলার এজাহারে আসামি হিসেবে নাম থাকলেও চার্জশিটে নাম দেওয়া যায় না। ফাইনাল রিপোর্টে তাঁরা খালাস পেয়ে যান।
টেকনাফের নাফ নদীতে গত মঙ্গলবার (০৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তিন লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সদস্যরা। পাচারকাজে জড়িত সন্দেহে ঘটনাস্থল থেকে ১২ জনকে আটক করা হয়। এছাড়া, পাচারকারীদের বহনকৃত একটি ট্রলারও জব্দ করা হয়। এসব ইয়াবার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা।
এছাড়া একইদিন সকাল ৯টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় নাফ নদীর মোহনায় অভিযান চালিয়ে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ ৮জন মাঝি-মাল্লাকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-৪২ এর সদস্যরা। এসময় ইয়াবাবাহী দু’টি ট্রলার জব্দ করা হয়েছে। আটক সবাই কক্সবাজারের মহেশখালী এলাকার বাসিন্দা। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
শুক্রবার (৩০ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে টেকনাফ পৌরসভার এস.কে খাল এলাকার আর.এম ফিশারিজ থেকে ৫০ হাজার ইয়াবাসহ রহমত উল্লাহ (৪২) নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেছে পুলিশ। আটক রহমত উল্লাহ পুরাণ পল্লান পাড়ার কালা মিয়ার ছেলে।
বৃহস্পতিবার (২৯ জানুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার উপরের বাজার এলাকা থেকে ৪০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ দু’জনকে আটক করেছে পুলিশ। আটক ব্যক্তিরা হলেন, টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামের মৃত সাবের আহমদের ছেলে নজরুল ইসলাম (২০) ও দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার মৃত হাজী আব্দুল আহামদের ছেলে মোহাম্মদ আলম (৪০)।
১৭ জানুয়ারী ভোরে টেকনাফ শাহ পরীর দ্বীপ ঘোলারচর এলাকা থেকে ১ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ সময় ট্রলারে থাকা পাচারকারীরা বিজিবি’র উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায়। এ ইয়াবার আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি টাকা।
মঙ্গলবার (১৩জানুয়ারী) রাত ১০টার দিকে টেকনাফের নাফ নদীর ৩নং সুইচগেট এলাকা থেকে ৬০ হাজার পিস ইয়াবাসহ মায়ানমারের ৪ নাগরিককে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। উদ্ধারকৃত ইয়াবার আনুমানিক মূল্য ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
পুলিশ সুত্রে জানায়, চলতি বছরের ১ থেকে ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত টেকনাফ থানা পুলিশ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পৃথকভাবে অভিযান চালিয়ে দুই লাখ ৩১ হাজার ২৩৬ পিস ইয়াবা সহ ৪৮জনকে আটক করে ৩৫টি মামলা রুজু করা হয়েছে।
৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে.কর্নেল মো. আবু জার আল জাহিদ জানান, ইয়াবা পাচার রোধ করতে সীমান্তে টহল বাড়ানো হয়েছে। প্রতিনিয়ত ইয়াবার বড় বড় চালান আটক করা হচ্ছে। গত জানুয়ারী মাসে ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭১৯ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে এক লাখ ৪১ হাজার ৫২৭ পিস ইয়াবাসহ ১৬ জনকে আটক করে ১০টি মামলা রুজু করে থানা পুলিশে সোর্পদ করা হয়েছে।
র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব-৭ কক্সবাজারের ইনর্চাজ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ইয়াবার বিরুদ্ধে জলে স্থলে তাদের অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। এ কারণেই গত এক সপ্তাহে ৪ লক্ষাধিক ইয়াবা জব্ধ করা হয়েছে।
এভাবে প্রতিদিনই কক্সবাজার জেলার কোন না কোন স্থান থেকে উদ্ধার হচ্ছে ইয়াবা এবং পাচারে জড়িতরাও গ্রেফতার হচ্ছে, তবুও থামছে না ইয়াবা পাচার। জীবনবিধ্বংসী ইয়াবা গডফাদারদের গ্রেফতার করা না হলে কিংবা গ্রেফতারকৃতরা আইনের ফাঁকে জেল হতে বের হতে না পারলে তবেই বন্ধ হবে ইয়াবা পাচার এমন অভিমত এলাকার সচেতন মহলের।


শেয়ার করুন