সম্ভবনাময় তরুণ সমাজকে বোধহীন করা হচ্ছে

images (1)মাওলানা জুলফিকার

আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো- প্রথাগত কাহিনীতে কথিত প্রেম বা কামাচারের প্রস্তাবে ভারতীয় নারীর সাড়া দেয়া না দেয়ার চিত্রায়ণ। বহুদিন ধরে চলতে থাকা এই ছকবাঁধা উপস্থাপনটা এমন যে- কোনো নারী যখন কারও প্রস্তাবে ‘না’ বলে আসলে সে অসম্মতি জানায় না, ভারতীয় নারীর ধরনটাই যেন এমন যে, মুখে ‘না’ বললেও মনে মনে সে যেন বিষয়টা ঠিকই মেনে নিচ্ছে।
কিছুদিন আগেই ভারতের ধ্রুপদি অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার ‘শোলে’র থ্রিডি সংস্করণের দর্শক জানিয়েছে- সেখানে একজন নারী তার দিকে প্রবলভাবে এগিয়ে আসতে থাকা এক পুরুষকে শক্তভাবেই না বলছে। ঘটনার একপর্যায়ে ওই নারীকে হাল ছেড়ে দেয় এবং দর্শক এমন একটা ধারণা পায় যে, আসলে ওই নারীর ‘না’ বলাটা আসলে না ছিল না, ওটা আসলে ‘হ্যাঁ’-ই ছিল! নারী-পুরুষের মধ্যে কামাচারের সম্পর্কের এই বোঝাপড়া ভারতীয় সিনেমায় সাধারণ ঘটনা। বলিউডের সিনেমায় কোনো পুরুষের পক্ষে কোনো নারীর পেছনে লেগে থাকার ঘটনা অগ্রহণযোগ্য কিছু নয়।
এটা এখন বহু প্রচারিত যে, বলিউডের সিনেমা আর ভারতের কিছু টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো দর্শকদের সামনে এমন এক ভোগ-বিলাসী জগতের ছবি তুলে ধরছে, যেখানে বিলাসী জীবন কাটানো কোনো সমস্যাই নয়। আর এভাবে দর্শকদের মধ্যেও ওই রকম জীবন কাটানোর প্রবল আকাঙ্খা তৈরি করা হচ্ছে। কেউ কেউ এমন ভাবে যে, সিনেমা-টিভি’র এই বাস্তবতা আর দিনকে দিন স্বনির্ভরতার পথে পা বাড়িয়ে আরো বেশি সংখ্যায় নারীদের নগরগুলোতে পাড়ি দিতে থাকা মিলিয়ে এমন অবস্থা তৈরি করা হয়েছে যে, অনেক পুরুষেরাই এতে ক্ষেপে যাচ্ছে আর যৌন সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে।
ভারতে যখন এই যৌন সহিংসতা নিয়ে তুমুল ঝড় উঠছে, তখন এ কথা মনে করা যেতে পারে যে, আইনি অভিযোগের নথিপত্রের হিসাব মতে- যুক্তরাষ্ট্রে সম্ভ্রমহরণের ঘটনা ভারতের চেয়েও বেশি। হলিউডের সিনেমায় নারী চরিত্র নিয়েও অনেক কথা হতে পারে। কিন্তু যে কেউই হয়তো স্বীকার করবে- হলিউডের নারী চরিত্ররা বলিউডের নারী চরিত্রের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তবের কাছাকাছি। অবশ্যই, পর্দায় কীভাবে উপস্থাপিত হলো তার পাশাপাশি সমাজের আরো অনেক কিছুই নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত, তা ভারতেই হোক কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে।
এদিকে এ দেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক সিনেমায় ভারতের সিনেমার কাহিনীই শুধু নকল করা হচ্ছে না, গানের সুর, নাচের মুদ্রা, নায়ক-নায়িকাদের পোশাক সবই হিন্দির অনুকরণে হচ্ছে। এদেশের সিনেমায় অশ্লীলতাও এসেছে হিন্দির প্রভাবে। তাই ডিশের অশ্লীলতায় এদেশের অর্থলোভী নির্মাতারা সিনেমায় নিয়ে এলো রগরগে নারী দেহের প্রদর্শনী। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত অনুষ্ঠান, উপস্থাপনার ধরন, বিজ্ঞাপনের ভাষা, নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান সবই হচ্ছে হিন্দি স্টাইলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বলেছে, এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এখানে সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক অনুশাসন দুর্বল হয়ে যাবে।
যারা এসব হিন্দি অনুষ্ঠান নির্বিচারে দেখে এবং এর প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে লোভ এবং ভোগবাদী চিন্তা-চেতনা বাসা বাঁধতে থাকে। চেষ্টা সাধনা সহজে এবং বিনা পরিশ্রমে গাড়ি, বাড়ি বিত্ত-বৈভব সব কিছু পাওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠে তাদের মধ্যে। ডিশ আছে এমন সব বাসার ছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে আলাপ করে দেখা গেছে, তারা বড়দের অনেক বিষয় সম্পর্কেও বেশ অবগত। হিন্দি বেশি দেখছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। উচ্চ বিত্ত শ্রেণী আবার ইংরেজি চ্যানেলগুলো বেশি দেখছে। হিন্দির প্রভাব বেশি পড়ছে শিশু, কিশোর টিনেজার ও যুবকদের মধ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর কামরুল আহসানের মতে-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গৃহিনীরা খুব বেশি হিন্দি অনুষ্ঠান দেখে এবং তাদের উপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। তাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কচ্ছেদ, পরকীয়া, অশান্তি ইত্যাদি বাসা বাঁধছে পরিবারগুলোতে। হিন্দি সংস্কৃতি প্রথমত আমাদের ভারতীয়করণ এবং তারপর পশ্চিমাকরণ করছে। পার্টি ও পার্লার কালচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেয়েদের মধ্যে ওড়না না পরা এবং প্যান্ট, টি-শার্ট, টাইট সংক্ষিপ্ত পোশাক পরে বাইরে বের হওয়ার প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে। নাচ-গানের স্কুলে শিশুদের ভিড় বাড়ছে। মদ কালচার অপরাধ, অপরাধ প্রবণতা ও পারিবারিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে।
হিন্দির মাধ্যমে সেক্স নামক আফিম খাইয়ে আমাদের যুব সমাজকে ঘুমিয়ে রাখার এবং অথর্ব বানানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আধিপত্যের বিরুদ্ধে তারা যেন সচেতন না হতে পারে, এ প্রশ্ন করতে না পারে সেজন্য যৌনতার আফিম নামক নেশায় ডুবিয়ে রাখা দরকার। এটি সে পরিকল্পনারই একটি অংশ। হিন্দি চলচ্চিত্রের গান, পপ আর রিমিক্স গানের অশ্লীলতা পর্নোগ্রাফীর চেয়েও ভয়াবহ। কারণ এসব গানে এমন ভয়াবহভাবে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গীসহ নারীদেহ উপস্থাপন করা হয়, যা পর্নোগ্রাফীর চেয়েও বেশি উদ্দীপিত করে বলে জানিয়েছে দর্শক এবং বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন হিন্দি চ্যানেলে আগে শুধু সিনেমার গান প্রচার করা হতো। এখন বিভিন্ন কোম্পানী সিনেমার গানের আদলে পপ এবং রিমিক্স গানের ভিডিও, সিডি ডিভিডি বাজারে ছাড়ছে। মূলত এগুলোই এখন বেশি প্রচার করা হচ্ছে বিভিন্ন চ্যানেলে। কারণ এগুলো এতটাই অশ্লীল যে, হিন্দি চলচ্চিত্রের অশ্লীলতা এখানে তুচ্ছ। হিন্দি ছবির গান এবং পপ রিমিক্স গানের সিডি ডিভিডি’র মধ্যে চলছে এখন ভয়াবহ অশ্লীলতার প্রতিযোগিতা। ফলে সিনেমার গানের অশ্লীলতায় আনা হচ্ছে নিত্য নতুন কৌশল। হিন্দি ছবির গানে অশ্লীলতা আগে ছিল পুরুষ কেন্দ্রিক। অর্থাৎ নারীদেহ প্রদর্শন করা হতে শুধু মাত্র পুরুষদের আনন্দের জন্য। তবে এখন নারীদের জন্যও বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নারীদেহের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির সাথে এখন পুরুষদের মাধ্যমে চরম অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দেখানো হয়। সুঠাম দেহের পুরুষ দিয়ে এখন খালি গায়ে অভিনয় করা হয় নারীদের বিনোদনের জন্য।
আরেকটি বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো- তথাকথিত ‘আইটেম নাম্বার্স’ বা ‘আইটেম গান’।
ধারণের কাছে এসব তুমুল জনপ্রিয়, খুবই সচেতনভাবে কোরিওগ্রাফি করা এবং বিশেষ যৌনতার আকর্ষণে ঠাসা ‘নাচে-গানে-ভরপুর’ ধরনের। বর্তমান সমাজে খুবই উপভোগ্য বিনোদন বলিউড সিনেমার নিয়মিত অনুষঙ্গ এই আইটেম গান।
অভিজ্ঞতা থেকে সমাজ গবেষকরা উদাহারণ দেন: বিয়ের একটি কমিউনিটি সেন্টারে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। বর-কনে উভয় পক্ষের কয়েকশ অথিতির আগমনে ভরে উঠেছে ঘর। ভুরিভোজনের পর অথিতিরা বিভিন্ন জায়গায় বসে গল্প-গুজব, হাসি-তামাশা করছে। হঠাৎ ধুম মাচালে ধুম মাচালে ধুম-হিন্দি গানের বিকট শব্দ আর মিউজিকে কেঁপে উঠলো পুরো ঘর। তালে তালে নাচতে শুরু করলো কয়েকজন তরুণী। সেই সাথে নায়ক-নায়িকার মতো ছেলে-মেয়েরা উদ্যম নাচ শুরু করলো। এভাবে উদ্যম নাচ-গানে আর অশলীনতায় কেটে যাচ্ছে রাত। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বাংলাদেশের শহরে-নগরে, গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র হিন্দি গান বাজানো ছাড়া এখন আর বিয়ের অনুষ্ঠান কল্পনা করা যায় না। সরকারি অফিস, পিকনিকে আসা যাওয়া, বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা, রান্না-বান্না সবই করছে হিন্দি গানের তালে তালে। গ্রামে, শহরে, উৎসবে, আনন্দে, বিয়ে-শাদী, জন্মদিন, স্কুল-কলেজের প্রতিযোগিতা, মার্কেট, শপিংমল, অলিগলি, পাড়া-মহল্লায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ভিডিও দোকানে, চায়ের দোকানে, বাসের ভেতর, লঞ্চের ডেকে সর্বত্রই হিন্দি গান বাজানোর প্রতিযোগিতা।
বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে হিন্দি গানের বিজ্ঞাপন। মোবাইলে রিং টোনে, বাস ট্রেনে ও লঞ্চের সিটে তরুণ-তরুণী দেখছে হিন্দি গান। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি শেষে বাসায় যেতে যেতে ছাত্র-ছাত্রীরা আলোচনা করছে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি ছবি নিয়ে। তরুণ-তরুণীদের শোবার ঘরে শোভা পাচ্ছে হিন্দি নায়ক-নায়িকাদের ছবি।
শুধু হিন্দি নয়, হলিউডসহ আরো অনেক অপসংস্কৃতি বর্তমানে বাংলাদেশে বানের পানির মতো প্রবেশ করছে। মূলত, যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সে সংস্কৃতিও নিয়ন্ত্রণ করে। এটিই সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া ডিফিউশন তত্ত্ব অনুযায়ী একটি সংস্কৃতি শক্তিশালী হলে তার প্রভাব আশে-পাশের অঞ্চল বা দেশে পড়ে থাকে।
উল্লেখ্য, এ অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা এজেন্ট হিসাবে বেঁচে নিয়েছে ভারতকে। সেজন্য আমরা দেখতে পাই- বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের স্বার্থে এক সুরে কথা বলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এসব প্রতিষ্ঠান ও ভারতে গ্যাস রফতানির কথা বলে, ট্রানজিট প্রদানের কথা বলে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের এত তিক্ততা, ট্রানজিট, গ্যাস, করিডোর না দেয়ার দাবি থাকলেও এখানে ভারতের হিন্দি আগ্রাসনের প্রভাব নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। সাম্রাজ্যবাদীরা এবং তাদের এজেন্টরা বুঝলো সাম্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষকে সব দিকে থেকে ভুলিয়ে রাখতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে যাতে মানুষ সচেতন হতে না পারে, প্রতিবাদ করতে না পারে এবং প্রশ্ন করতে না পারে, সেজন্য তাদের কোনো এক নেশাতে মাতিয়ে সব কিছু থেকে ভুলিয়ে রাখা দরকার বলে তারা মনে করে। তাই তাদের এ নেশা হলো সেক্স। হিন্দির মাধ্যমে এদেশের সাধারণ মানুষকে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। নাঊযুবিল্লাহ! সেক্সের নেশা খাওয়ানো হচ্ছে। ভোগবাদিতার দিকে উসকে দেয়া হচ্ছে। আমাদের সম্ভবনাময় তরুণ সমাজকে বোধহীন করা হচ্ছে। উদ্দ্যেশ্য একটাই বাংলাদেশের শক্তিকে খর্ব করা। স্বাধীনতা হরণ করা। এদেশের অপার সম্পদ লুণ্ঠন করা।


শেয়ার করুন