সমুদ্রপথে বাংলাদেশিদের ইতালি যাত্রা : ৯৮% লিবিয়ায় ছিল!

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়েছে। গত বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ১৩১। আর এ বছর প্রথম পাঁচ মাসেই গেছে ৭ হাজার ১০৬ জন, যা ইতালিতে মোট অবৈধ প্রবেশকারীদের ১১ শতাংশ। বাংলাদেশিদের এভাবে দেশত্যাগের জন্য আর্থিক সংকটকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশি অভিবাসীদের ওপর জাতিসংঘের অভিবাসী সংস্থা পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তরদাতাদের ৯৮ শতাংশ বলেছে, ইতালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে তারা এক বছরের বেশি সময় লিবিয়ায় ছিল। তাদের অধিকাংশই অবিবাহিত পুরুষ।

কেবল ইতালিই নয়, এ বছর সাগরপথে অবৈধভাবে যত লোক ইউরোপে প্রবেশ করেছে, বাংলাদেশ সেই তালিকার অন্যতম। এর আগে ২০১৫ সালে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশে মালয়েশিয়া সীমান্তবর্তীর জঙ্গলে বেশ কিছু গণকবর আবিষ্কার হয়। তখন সাগরপথে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে। ২০১৪-১৫ সালে এই পথে প্রায় ৯৩ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গেছে। অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, মারাও গেছে। তারা কাজের সন্ধানে বা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে দেশ ছেড়েছিল।

বাংলদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫-১৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ।

থাইল্যান্ড সরকার পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পর বঙ্গোপসাগর দিয়ে মানব পাচার আপাতত বন্ধ হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমধ্যসাগর রুটে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। যদিও এমন বিপজ্জনক পথে বাংলাদেশিদের ইউরোপে পাচার শুরু হয় অনেক আগে। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাস বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে।

আজ ৩০ জুলাই আন্তর্জাতিক মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস। এ উপলক্ষে গতকাল ঢাকায় ব্র্যাক আয়োজিত এক পরামর্শ সভায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও মানব পাচারের সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। পাচারের সঙ্গে জড়িত ‘গডফাদারদের’ তালিকা করে তাদের ধরতে হবে।

অবৈধভাবে ইউরোপে যাত্রার আগে বাংলাদেশিরা সাধারণত আকাশপথে দুবাই-ইস্তাম্বুল-ত্রিপোলি, দুবাই-কায়রো-খার্তুম-ত্রিপোলি কিংবা দুবাই-ইস্তাম্বুল-তিউনিস হয়ে লিবিয়ায় যায়। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় দুবাই বা ইস্তাম্বুল হয়ে লিবিয়া রুট। এরপর লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় গাদাগাদি করে ইতালির উপকূলের উদ্দেশে যাত্রা করে।

১৭ জুলাই ইতালির রোমে জাতিসংঘের অভিবাসী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) কো-অর্ডিনেশন অফিস ফর দ্য মেডিটেরিনিয়ানের পরিচালক ফেদেরিকো সোডার সঙ্গে তাঁর দপ্তরে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশিরাই কেন এত বেশি হারে এই অবৈধ পথে আসছে, তা আমরা জানি না। এর রহস্য আমরাও বুঝতে চাই। কারণ আমরা মনে করি, বিশ্বের যেসব দেশ উদ্বাস্তু তৈরি করে, তেমন দেশ অবশ্যই বাংলাদেশ নয়।’

ইতালিতে আইওএমের দপ্তর ২০১৬ ও ২০১৭ সালের মধ্যে ৬১৯ জন বাংলাদেশির তাদের ডিসপ্লেসমেন্ট ট্র্যাকিং মেট্রিকসের (ডিটিএম) আওতায় সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তাদের সবাই পুরুষ। ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী অভিবাসী শিশু-কিশোরের সংখ্যা ২০১৬ সালে ছিল ৩৫ শতাংশ, যা চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

২০১৬ সালের জুনে আইওএমের আওতায় ডিটিএমের কাজ শুরু হয়। ভূমধ্যসাগরের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের ওপর গবেষণা করা তার কাজ। এটি এ পর্যন্ত ইতালির ছয়টি অঞ্চলে বিস্তৃত হয়েছে। ১৪ বছরের বেশি বয়সী যারা ২০১৬ থেকে ইতালিতে পৌঁছেছে, তাদেরই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে সোডা বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে দিয়েই প্রথম কাজ শুরু করি। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য দেশের ওপরও এ রকম প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।’

আইওএমের সমীক্ষায় ২০১৬ ও ২০১৭ সালের উত্তরদাতাদের অধিকাংশই বাংলাদেশ ত্যাগ করার মূল কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক বিবেচনাকে চিহ্নিত করেছে। ২০১৭ সালের উত্তরদাতাদের প্রশ্নমালায় দেশত্যাগের কারণ হিসেবে একাধিক বিকল্প উল্লেখ ছিল। এর মধ্যে ৬৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৯৫ শতাংশ শিশু (যাদের গড় বয়স ১৭) দেশত্যাগের কারণ হিসেবে আর্থিক সংকটকে চিহ্নিত করে। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ৩০ শতাংশ এবং শিশুদের ২৮ শতাংশ ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। এ ছাড়া ১১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও ১৪ শতাংশ শিশু জীবন ধারণের মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত থাকার কথাও উল্লেখ করে। এ ছাড়া ৩২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক দেশত্যাগের কারণ হিসেবে মানবিক সেবার অভাবকে চিহ্নিত করেন।

ওই সীমাক্ষা প্রতিবেদন বলছে, সমুদ্রপথে আসা বাংলাদেশি অভিবাসীদের বেশির ভাগ ইতালিতে থাকার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। কারণ, তারা ইতালিকে নিরাপদ এবং আর্থসামাজিক সুবিধার দিক থেকে অনুকূল মনে করে। এ বছর ৮৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও ৯৭ শতাংশ শিশু ইতালিতে থাকতে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। খুব অল্পসংখ্যক উত্তরদাতা তাদের পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য বা জার্মানির কথা উল্লেখ করেছে।

২০১৬ সালে সমুদ্রপথে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ১৩১। এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে সমুদ্রপথে ৭ হাজার ১০৬ জন বাংলাদেশি ইতালিতে এসেছে। এদের অধিকাংশই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। গত বছর যাঁদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৬ শতাংশ এবং শিশু ছিল ১৪ শতাংশ।

ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সমুদ্রপথে ১ লাখ ৮১ হাজার ৪৩৬ জন ইতালিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে অন্যান্য দেশের ২৪ হাজারের বেশি নারী থাকলেও বাংলাদেশের নারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৫। এ ছাড়া অভিভাবকহীন শিশুর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৫৩। এ বছর প্রথম ৫ মাসে ৬০ হাজার ২২৮ জন বিদেশি সমুদ্রপথে ইতালিতে এসেছে। এর মধ্যে ১৩ শতাংশ বাংলাদেশি এবং অভিভাবকহীন শিশুর সংখ্যা ১৪ শতাংশের বেশি।

ঢাকারই বেশি

ইতালিতে আসা অধিকাংশ বাংলাদেশি অভিবাসীর শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক। শিশুদের গড় বয়স ১৭ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ২৫। সাক্ষাৎকার প্রদানকারীদের অর্ধেকের বেশি বলেছে, তারা এসেছে ঢাকা থেকে। ৭ শতাংশ বৃহত্তর ঢাকার। অন্য এলাকার মধ্যে রয়েছে সিলেট, মাদারীপুর ও চট্টগ্রাম। এদের অর্ধেক ইতালিতে আসার আগে কর্মরত ছিল। ৩৮ শতাংশ বলেছে, তারা বেকার ছিল।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উত্তরদাতাদের ৯৮ শতাংশ বলেছে, ইতালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে তারা এক বছরের বেশি সময় লিবিয়ায় ছিল। সেখানে তারা প্রধানত গৃহকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মালি ও হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মী হিসেবে কাজ করেছে। লিবিয়ায় পৌঁছার পরপরই পাসপোর্ট জব্দ করা হয় এবং হোটেল বা বাসাবাড়িতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্তরীণ রাখা বা কাজ করতে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটেছে।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে পৌঁছাতে তাদের খরচ হয়েছে ৫ হাজার মার্কিন ডলারের (চার লাখ টাকা) বেশি। এরা বিমানযোগে দুবাই বা ইস্তাম্বুল হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছানোর আগে কোনো বাংলাদেশি দালালকে সমুদয় টাকা বুঝিয়ে দিয়েছে। ৮১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, তাদের ইতালিতে আসার খরচ আত্মীয়রা জুগিয়েছেন।

সোডা মনে করেন, শুধু লিবিয়ায় পৌঁছাতেই প্রত্যেক অভিবাসীর ৮ থেকে ৯ হাজার ডলার খরচ হয়। লিবিয়া থেকে ইতালিতে আসার খরচ অবশ্য মাথাপিছু ৭০০ ডলার। অভিবাসীরা তাদের যাত্রার শুরুতেই পুরো টাকা দেয় না। মানব পাচারকারীরা পরিবারের প্রধানের সই করা ‘ব্ল্যাংক চেক’ নেন। এরপর নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পরিশোধ করতে পরিবারের প্রধান সম্পদ বন্ধক দেন বা ঋণ করেন। এরপর তাঁরা বুঝতে পারেন, চাকরি নেই, তাঁরা ফাঁদে পড়েছেন।

সোডা মানব পাচারকারীদের অর্থ পরিশোধের আরেকটি বিকল্পের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। তাঁর কথায়, মানব পাচারকারীরা ইতালিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। এই ব্যবসায়ীরা ফুটপাতে সস্তা খেলনা বা গোলাপ বিক্রির মতো কাজের সংস্থান করেন। এরপর এজেন্টরা প্রতিশ্রুত টাকা উশুল করেন।

ইতালি সরকারের প্রস্তাবের ভিত্তিতে আইওএম রোমের অদূরে লাপান্তো এলাকায় ভূমধ্যসাগর দিয়ে প্রবেশকারী উদ্বাস্তুদের বিষয়ে নজরদারি করতে একটি সমন্বয় দপ্তর খুলেছে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের ইতালি থেকে ফিরিয়ে নিতে ঢাকা কোনো পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশিদের জন্য ইইউ ভিসা সীমিত করার হুমকি দিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জ্যাঁ-ক্লদ জাঙ্কার। ইতালির প্রধানমন্ত্রী পাবলো জেন্তিলনিকে গত মঙ্গলবার দেওয়া এক চিঠিতে জাঙ্কার ওই হুমকির বিষয়টি উল্লেখ করেন বলে ভয়েস অব আমেরিকা বুধবার জানিয়েছে। যোগাযোগ করা হলে ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি ‘সংবেদনশীল’ বিবেচনায় কোনো বক্তব্য দিতে চায়নি।


শেয়ার করুন