সব ঠিক আছে তো!

65737ac8a0a95205d37dbe1c82364d50-
অনেক খবর জানা যাচ্ছে। কিন্তু আসল খবর নেই। ‘দুই খুনির’ আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা আগ্নেয়াস্ত্রসহ আরও দু’জন আটকের খবর আছে। পেশাদার কিলারের কথাও আমরা জানি। আরও জানি কত টাকার বিনিময়ে হত্যা করা হলো। কিন্তু যে খবরটি জানি না তা হলো- কারা খুন করালো। কারা পেশাদার খুনি ভাড়া করলো। আর তারা কেনইবা হত্যা করালো।
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত, হত্যাকাণ্ডের চেয়েও বেশি। আর এটা তুমুল আলোচনার জন্ম দেয় গত শুক্রবার রাতে বাবুল আক্তারকে তুলে নিয়ে গিয়ে পুলিশের টানা ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর। আর সেই ঘটনার ডালপালা এখনও বাড়ছে। সংবাদ মাধ্যম নানা সূত্র থেকে তথ্য দিচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য হলো- ‘পুলিশের চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার শর্তে বাবুল আক্তারকে রেহাই দেওয়া হচ্ছে।’ তবে যে প্রভাবশালী দৈনিক অসমর্থিত সূত্র থেকে এই তথ্য দিয়েছে, তারা কিন্তু স্পষ্ট করে বলেনি যে মিতু হত্যাকাণ্ডে এসপি বাবুল আক্তারের সংশ্লিষ্টতা কোন ধরনের।
তারা বলছে, ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গত শুক্রবার রাতে বাবুলকে ডিবি কার্যালয়ে আনার পর এক উপকমিশনারের কক্ষে ডিআইজি পদমর্যাদার তিনজন কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ওই সময় তাকে দুটি শর্ত দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। বলা হয়, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সব তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। তাকে জেলে যেতে হবে অথবা বাহিনী থেকে সরে যেতে হবে। বাহিনী থেকে সরে যাওয়ার ব্যাপারে বাবুল সম্মতি দেন বলে জানা গেছে।’
অন্যদিকে ডেভেলপিং স্টোরির মতো আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও ডেভেলপিং স্টেটমেন্ট দিয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ মঙ্গলবার সকালে তিনি মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘তিনি (এসপি বাবুল) নজরদারিতে আছেন, আমরা কখনও বলিনি। বাবুল আক্তারকে দায়ি করা কিংবা বাবুল আক্তার জড়িত কি না, সে প্রসঙ্গ এখনও আসেনি।’
তবে এর আগে রোববার ওই প্রভাবশালী বাংলা দৈনিকটি বাবুল আক্তারের প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যে বক্তব্য ছাপে তা হলো- ‘বাবুল আক্তারকে নিয়ে ক্রিমিনালদের সামনাসামনি করা হয়েছে। তারা যা বলেছে তা যাচাই করা হয়েছে।’ কিন্তু এই খুনের ঘটনা নিয়ে নানা জন নানা মন্তব্য করছে। কেউ কেউ তাদের পারিবারিক বিষয়েও মন্তব্য করছেন। এসব কি সত্যি? জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘হতে পারে। তবে এখনও প্রকাশ করার সময় আসেনি, আমরা সবকিছুই প্রকাশ করব আরও একটু সময় নিয়ে।’ সুতরাং এটা স্পষ্ট যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মঙ্গলবার তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন।

আর প্রভাবশালী দৈনিকটির অমর্থিত সূত্রের তথ্য সত্য ধরে নিলে প্রশ্ন ওঠে- চাকরি ছেড়ে দিলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ‘স্ত্রী হত্যায় জড়িত’ থাকার দায় থেকে মুক্তি পেতে পারেন কি না। পুলিশের জন্য হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে দেশে কি নতুন আইন হয়েছে? পুলিশই কি ঠিক করে দেবে কে দায়ি কে দায়ি নয়? না তথ্য প্রমাণ ঠিক করবে? আর তা করতে হলে তো ‘জজ মিয়া নাটক’ করতে হবে। পত্রিকাটির উচিৎ হবে অসর্থিত সূত্রের তথ্য প্রমাণ পাঠকদের কাছে তুলে ধরা। আমি একজন পাঠক হিসেবে সেই দাবি করছি।

বাজারে এবং সংবাদ মাধ্যমে এখন যে তথ্যগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো:

১. বাবুল আক্তার তার স্ত্রী মিতু হত্যায় জড়িত বলে সন্দেহ

২. বাবুল আক্তারের পুলিশিংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কোনও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট মিতু হত্যায় জড়িত বলে সন্দেহ

৩. বাবুল আক্তারকে পুলিশে তার বিরোধীপক্ষ ফাঁসানোর চেষ্টা করছে

৪. প্রথমে বলা হলেও এখন আর জঙ্গিরা জড়িত তা মনে হচ্ছে না।

আদালতে জবানবন্দি এবং পুলিশের সোর্স পর্ব
চট্টগ্রাম পুলিশ মিতু হত্যায় এ পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। সেমাবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় ওয়াসিম ও আনোয়ার। চট্টগ্রাম পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে ওইদিন তাদের জবানবন্দির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ওয়াসিম সরাসরি মিতুকে গুলি করেছে। তারা এর মোটিভ বা কারা তাদের ভাড়া করেছে তা জানায়নি। একদির পর আদালত থেকে পাওয়া জবানবন্দিতে দেখা যায়, আনোয়ার তার জবানবন্দিতে জানিয়েছে, ওয়াসিম মিতুকে গুলি করে। তবে ওয়াসিম দাবি করেছে, সে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। মুছা মিতুর মাথায় গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।’ তাহলে পুলিশের ভাষ্য এবং জবানবন্দিতে গরমিল দেখা যাচ্ছে।

এই মুছা হলো পুলিশের সোর্স। জবানবন্দিতে বলা হয়েছে- ‘পুলিশের সোর্স মুছা খুন করার জন্য তাদের ভাড়া করে। খুন করার আগ পর্যন্ত তারা মিতুর পরিচয় জানত না। টেলিভিশনের খবরে তারা মিতুর পরিচয় জানতে পারে। প্রত্যেক ভাড়াটে খুনিকে দুই থেকে আড়াই হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। হত্যা মিশনের জন্য ভোলা নামের একজন তাদের দুটি আগ্নেয়াস্ত্র দেয়।’

সোমবার চট্টগ্রাম পুলিশ আরও দু’জনকে গ্রেফতার করেছে মিতু হত্যায় ব্যবহৃত দু’টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ। আটক দু’জন হলো- ভোলা ও মনির। এই ভোলা ‘খুনিদের’ অস্ত্র দিয়েছে বলে আগে আটক দু’জন তাদের জবানবন্দিতে বলেছে। আর মনির অস্ত্র দিয়েছে ভোলাকে।

কিন্তু এখন যাকে প্রয়োজন তিনি হলেন পুলিশের সোর্স মুছা। এ পর্যন্ত যা জানা গেল তাতে মুছা হলো হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সর্বশেষ স্তর। সে নিজেও সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে। মুছাই বলতে পারবে তাকে কে এই কাজ দিয়েছে।
কিন্তু এখানও পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী মুছা আটক হয়নি। কিন্তু এই মুছাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মিতু হত্যার নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশ দাতাদের শনাক্ত করতে। জানতে হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য বা মোটিভ। কারণ যারা হত্যা করেছে বলে পুলিশ জানাচ্ছে, তারা পেশাদার ও ভাড়াটে কিলার বলে পুলিশের দাবি। তাই যদি হয়, তাহলে তাদের সাধারণ নিয়মে মোটিভ জানার কথা না। মোটিভ জানবে মুছা বা মুছা পরবর্তী স্তরে যাদের নাম বলবে তারা। কিন্তু মুছার অনুপস্থিতি বা মৃত্যু মিতু হত্যার নির্দেশদাতা বা নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীদের আড়াল করবে। আড়াল করবে হত্যাকাণ্ডের মোটিভ। তাই ঘটনা প্রবাহে আরও একটি ক্রসফয়ারের অশঙ্কা করছি। কেন এই আশঙ্কা তার ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে।

একটি প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক যে ‘সমঝোতার’ কথা বলেছে, তা সত্য হলে সেই সমঝোতা অনুয়ায়ী কাজ করতে হলে মুছাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। তাহলে তো আর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ‘খুনের দায়’ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। পুলিশের সোর্স মুছাতো বলে দেবে। নাম প্রকাশ করবে। মোটিভ জানাবে।

পুলিশের একটি অংশ বাবুল আক্তারকে ফাঁসাতে- এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তাদের জন্যও মুছা আতঙ্কের। মুছা যদি তাদের ‘ছক’ অনুযায়ী তথ্য না দেয়, তাহলে পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। তখন উল্টো বাবুল আক্তারকে যারা ফাঁসানোর জন্য চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠছে, তারা ফেঁসে যেতে পারেন।

বাবুল আক্তারের পুলিশিংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কোনও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট মিতু হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে যে কথা শোনা যাচ্ছে, তারাও চাইবে না মুছা ধড়া পরুক বা বেঁচে থাকুক। কারণ মুছা তাদের নাম বলে দিলে তা তাদের জন্য ভয়ঙ্কর। তবে ক্রসফায়ার না হয়ে পুলিশের সোর্স মুছা চিরতরে নিখোঁজও হয়ে যেতে পারে। তাকে হয়তো আর কখনওই পাওয়া যাবে না। আর তাই যদি হয়, তাহলে মিতু হত্যাকাণ্ড একটি মোটিভলেস মার্ডারে পরিণত হবে। বেঁচে যাবে নেপথ্যের অপরাধীরা।

আসামি বা সন্দেহভাজনদের জবানবন্দিই কোনও অপরাধ বা হত্যাকাণ্ড প্রমাণের জন্য যথেষ্ঠ নয়। তারা আদালতে জবানবন্দিতে যা বলে, তা আবার ঘাটে ঘাটে তথ্য, ডকুমেন্ট, আলামতসহ নানা সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট করতে হয়। আর সে কারণেই একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর ‘জজ মিয়ার জবানবন্দি’ বাংলাদেশে সাজানো জবানবন্দির একটি ক্ল্যাসিক উদাহরণে পরিণত হয়েছে। আর এই জবানবন্দি আদালতের মাধ্যমে প্রত্যাহারেরও সুযোগ আছে। তাই অপরাধ প্রমাণে সাক্ষ্য, ডকুমেন্ট, আলামতই বড় কথা, জবাবন্দি নয়। জবানবন্দি সঠিক হলে তা ধরে মামলার তদন্ত সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়া যায়।

এ পর্যন্ত জবানবন্দি থেকে আমরা যা জানি, তাতে পুলিশের সোর্স মুছাই বলতে পারে মিতু হত্যাকাণ্ডে জড়িত পরবর্তী উচ্চ ধাপগুলো সম্পর্কে। কারণ জবানবন্দিতে মুছার পরবর্তী ধাপের কারো নাম প্রকাশ হয়নি বলেই আমরা জানি। তাহলে মুছাকে আটকের আগেই কেন বাবুল আক্তারকে টানা ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ? কী এমন তথ্য জবানবন্দির বাইরে কার কাছ থেকে জানল পুলিশ বা সংবাদ মাধ্যম! তাহলে কি মুছা কারো গোপন হেফাজতে আছে?

লেখক:

হারুন উর রশীদ

সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

–বাংলা ট্রিবিউন


শেয়ার করুন