হাইকোর্টের রায়

শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী স্কুলব্যাগ নয়

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী ব্যাগ বহন করা যাবে না বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ের কপি পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে এ বিষয়ে আইন করতে সরকারকে নির্দেশও দিয়েছেন উচ্চ আদালত।

একই সঙ্গে এ আইন না করা পর্যন্ত শিক্ষার্থীর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী ব্যাগ বহন করা যাবে না মর্মে একটি পরিপত্র জারি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ৩০ দিনের মধ্যে এ পরিপত্র জারি করতে বলা হয়েছে।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশিষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ রায় দেন। রায়ে ওই পরিপত্রে বিষয়টি নজরদারির জন্য মনিটরিং সেল গঠন এবং আদেশ না মানলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে—এমন তথ্য রাখতে বলা হয়েছে। অন্যথায় এর দায়দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বহন করতে হবে বলে রায়ে বলা হয়েছে। এ ছাড়া এ বিষয়ে অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সচেতনতা বাড়াতে প্রযোজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

শিশুদের ভারী স্কুলব্যাগ বহন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী—ব্যারিস্টার এস এম মাসুদ হাসান দোলন, মো. জিয়াউল হক ও আনোয়ারুল করিমের করা এক রিট আবেদনে জারি করা রুলের ওপর শুনানি শেষে এ রায় দেন আদালত। শিশুদের ভারী স্কুলব্যাগ বহন নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে গত বছরের ৯ আগস্ট এ রিট আবেদন করা হয়। আদালতে রিট আবেদনকারী পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার এস এম মাসুদ হাসান দোলন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।

রায়ে আদালত বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন কী পরিমাণ হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন নেই। বেশি ওজনের ব্যাগ বহন করা শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এ জন্য শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের দিক লক্ষ রেখে সরকারকে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হলো। রায়ে আদালত বলেন, ‘ভারী ব্যাগ বহনের কারণে কোমলমতি শিশুদের মেরুদণ্ডের হাড় বাঁকা হয়ে যায়। এতে তার স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে। রায়ে বলা হয়, একজন মানুষের জন্য সব সময় সুস্থ শরীর প্রয়োজন। সারা জীবনের জন্য এটা প্রয়োজন। সুস্বাস্থ্য ছাড়া একজন মানুষ স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। পদে পদে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় আমাদের কোমলমতি শিশুরা ছোটকাল থেকেই ভারী ব্যাগ বহনের কারণে সমস্যার মুখে পড়ছে। তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হলে তার মাসুল পুরো জাতিকে গুনতে হবে। শিশুরা যদি এই ভারী ব্যাগ বহন করতে থাকে তাহলে আমাদের শিশুরা কখনো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারবে না। আর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে না পারলে তারা কখনো সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠতে পারবে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমগ্র জাতি। অথচ এটা রোধে আমাদের দেশে কোনো আইন নেই। ’

রায়ে বলা হয়, ‘দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের সিলেবাসে অতিরিক্ত বই সংযোজনের কারণে শিশুদের ভারী ব্যাগ বহন করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত ওজনের স্কুলব্যাগ বহনের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের শরীরে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। এ বিষয়ে নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। ’

রায়ে আরো বলা হয়, ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর সরকার একটি পরিপত্র জারি করে। ওই পরিপত্রে বলা হয়েছিল, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বিদ্যালয়গামী ছেলে/মেয়েদের জন্য যে সকল বই অনুমোদন করেছে তা পরিবহনে কোনো ছেলে/মেয়ের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যেসব ছাত্র/ছাত্রী ব্যাগে বই বহন করে বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করে তার ওজন তাদের বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থাৎ অনুমোদিত বইপুস্তকের ওজন একজন শিক্ষার্থীর ওজনের এক-দশমাংশের বেশি নয়। ছেলে/মেয়েরা বিশেষত শিশু, ১ম ও ২য় শ্রেণিতে অধ্যয়নরতদের জন্য ব্যাগ নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে ব্যাগটি যাতে বহনযোগ্য হয়। ভারী ব্যাগ বহনের কারণে যাতে পিঠে ব্যথা বা সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো সমস্যা দেখা না দেয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। তাই অনুমোদিত বই, উপকরণ ব্যতীত অন্য কিছু ব্যাগে করে বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা নিরুৎসাহিত করতে হবে। প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয়সমূহের প্রধানগণ এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। ’ বিষয়টি উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও তা কার্যকর দেখা যায় না। ২০১৬ সালেও এসে দেখা যাচ্ছে শিশুরা স্কুলের ভারী ব্যাগ বহন করছে। এই ব্যাগ বহনের বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের কোনো স্কুলেই নজরদারি দেখা যাচ্ছে না। ফলে শিশুদের শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

রায়ে বলা হয়, স্কুল কর্তৃপক্ষ সরকারের এই পরিপত্র মেনে চলছে না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি বরং নিশ্চুপ থেকেছে। ওই পরিপত্রটিও পরিপূর্ণ নয় ও যথেষ্ট নয়। এ জন্য নতুন করে পরিপত্র জারি করতে হবে।

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, ভারী স্কুলব্যাগ বহন করে পিঠে ব্যথা, সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারার কষ্ট নিয়ে শিশুরা চিকিৎসকের কাছে আসছে। এদের প্রায় সবাই বলছে, স্কুলব্যাগের ওজন বেশি, বহন করতে কষ্ট হয়। ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকার শিশুদের শারীরিক ওজনের ১০ শতাংশের বেশি নয় এমন স্কুলব্যাগ বহনে একটি নির্দেশনা জারি করেছে। সরকার যাতে একই রকম আইন করে সে বিষয়ে নির্দেশনা প্রয়োজন।

এ রিট আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে ওই বছরের ১১ আগস্ট রুল জারি করা হয়। রুলে শিশুদের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী স্কুলব্যাগ বহন না করা এবং প্রাক-প্রাথমিক শিশুদের স্কুলব্যাগ বহন না করতে আইন বা বিধি প্রণয়নের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। এ রুলের ওপর শুনানি শেষে গতকাল রায় দেওয়া হয়।

কালের কন্ঠ :


শেয়ার করুন