ফিরে দেখা ২০১৫

শিক্ষাক্ষেত্রে দুই ‘ন’র দ্বৈরথ

2015_12_29_10_26_29_9o7MxDwqmidujAPJ2phGAIAXzEnTUE_originalসিটিএন ডেস্ক:

অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্যের পাশাপাশি আছে ব্যর্থতার লম্বা সিরিয়াল। এক নজরে দেখে নেয়া যাক ২০১৫ সালের শিক্ষাক্ষেত্রের সংক্ষিপ্ত হালচাল।

বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দিয়ে অতীতের অর্জনের পালকে আরো একটি সফলতা যোগ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ সাফল্যের রেশ কাটতে না কাটতেই ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র রক্ষা ও গণতন্ত্র হত্যা দিবসের ফাঁদে পড়ে শিক্ষার্থী। যার ফলে মারত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। বাইরে বেরুলেই দাবানলে ছাড়খার হওয়ার মরণাতংক সঙ্গে পরীক্ষার সময়সূচি নিয়েও ছিলো ছন্নছাড়া অনিশ্চয়তা। যার ফলে আগের বছরের চেয়ে ফলাফলে দেখা যায় নিম্নসূচক।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বরাবরই বিতর্কিত হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা। ২০১৪ সালের এসএসসি, জেএসসি-জেডিসি, প্রাইমারি সমাপনি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে একেবারেই প্রকাশ্যে। হাত বাড়ালেই ফটোকপির দোকান থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সবখানে ছিল প্রশ্নপত্রের অবাধ আনাগোনা। প্রশ্নপত্র ফাঁসের এ নৈরাজ্য রোধে নানামুখী কৌশলী পদক্ষেপ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যার ফলে বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের তেমন খবর মেলেনি।

উত্তাপ ছড়ায় মেডিকেলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ভর্তিচ্ছুদের টানা অন্দোলন। সরকারের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হলেও মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা চলার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কর্মকর্তাসহ তিনজন গ্রেপ্তার, পরে ওই কর্মকর্তার মৃত্যু প্রশ্নফাঁস একটা ‘স্বাস্থ্যবান’ ইস্যুতে পরিণত করেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন জানায় গণজাগরণ মঞ্চসহ অনেকেই সমর্থন জানান। যদিও সরকার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় খালি হাতেই বাড়ি ফেরে তারা।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে এবছর আলোচিত হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির’র উপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। যে আন্দোলনকে বছরের সেরা গণআন্দেলনও বলা হয়। প্রথম থেকেই একটু একটু করে বলে আসলেও ১০ সেপ্টেম্বর থেকে রাস্তায় নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ওপর গুলিও চালায়। এ ঘটনার পরই মূলত আন্দোলন আরো জোরালো হয়। সঙ্গে যোগ দেয় বেসরকারি মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররা। এছাড়া এনবিআর, অর্থমন্ত্রী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতির পরস্পর বিরোধী বক্তব্য এ আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। আন্দোলন ক্রমেই দেশব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে স্থবির হয়ে পরে রাজধানী শহর ঢাকা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তোপে পড়ে ভ্যাট প্রত্যাহারে বাধ্য হয় অর্থমন্ত্রণালয়।

শিক্ষকদের আন্দোলনের বছর বলা হয় ২০১৫ সালকে। শিক্ষদের দাবি পূরণে এখনো কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বছরের শেষ মুহূর্তেও চলছে শিক্ষকদের ক্ষোভ ও আন্দোলন। ঘোষিত অষ্টম পে-স্কেলকে শিক্ষকদের আত্মসম্মান ও আর্থিকভাবে সংঘাতপূর্ণ আখ্যা দিয়েছেন শিক্ষকরা। প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ্বাবিদ্যালয়; কোনো শিক্ষাণনের শিক্ষকরাই পে-স্কেলে সন্তুষ্ট না। তাই বিভিন্ন দাবি উপস্থাপন করে চলছে তাদের আন্দোলন।

এসবকিছু ছাপিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রন্দিুতে ছিল শিক্ষামন্ত্রী-সাবেক শিক্ষা সচিবের দ্বন্দ্ব। যাকে দুই ‘ন’র দৈরথও বলা চলে। অর্থাৎ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও সদ্য অবসরে যাওয়া শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান। তাদের দাপ্তরিক দ্বন্দ্ব নিয়ে বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তোলপাড় ছিল গণমাধ্যমসহ সারাদেশ।

2015_10_15_13_29_45_YbzkxKNaeH1awzDdFgGjehGw36KLWw_originalএক নজরে মন্ত্রী-সচিবের দাপ্তরিক দ্বন্দ্ব
গত ৩১ ডিসেম্বর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশনা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

সিদ্ধান্তটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হলে এর পরের দিন ১ জানুয়ারি নির্দেশনাটি স্থগিত করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ওই সময় জানা যায়, ওই সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন শিক্ষা সচিব। পরে শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি জেনে স্থগিত করেন। অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ও অর্থের অপচয় কমতো।

এরপর ৩ মার্চ পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়ে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই পরিপত্রে বলা হয়, নির্বাচনী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলেও ক্লাসে ৭০ শতাংশ উপস্থিত শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। নির্বাচনী পরীক্ষায় এক বা একাধিক বিষয়ে অকৃতকার্যতার অজুহাতে স্কুল-কলেজগুলো পরীক্ষার্থী ছাঁটাই করে। কোন কোন ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে পরীক্ষার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু কেউ কেউ এ পরিপত্রের সমালোচনা করেন।

শিক্ষা সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান স্বাক্ষরিত এ পরিপত্রের বিষয়েও শিক্ষামন্ত্রী কিছু জানতেন না বলে জানা যায়। এতেও ক্ষুব্ধ হন মন্ত্রী। পরে এ পরিপত্রটি বাতিল করার উদ্যোগ নেয়া হলেও সম্পর্কের অবনতির কথা চিন্তা করে তা আর হয়নি বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান।

প্রত্যেকটি মহিলা শিক্ষাঙ্গণে বিউটি পার্লার, শিক্ষার্থীদের জন্য সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলকসহ আরো কিছু পরিপত্র জারি করেছিলেন তৎসময়ের শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান। যার সবকটি শিক্ষামন্ত্রী বাতিল করে দেন।

সর্বশেষ মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত পাশ কাটিয়ে সচিব সকল কলেজে অনলাইনে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন। অনভিজ্ঞতা ও যান্ত্রিক জটিলতায় লেজে-গোবরে অবস্থা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এতে চরম ক্ষুব্ধ হন শিক্ষামন্ত্রী। নির্দেশনাও জারি করেন শিক্ষামন্ত্রী, মন্ত্রীর মতামত ছাড়া কোনো কর্মকর্তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এ নির্দেশনা জারি করার পর অনেকটাই কমে যায় শিক্ষা সচিবের দাপ্তরিক ক্ষমতা। ফলে পরিপত্র, নীতিমালা, আইন জারি এবং জনমতের জন্যও কোনো কিছু ওয়েবসাইটে প্রদর্শনে অবশ্যই অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি করে দেন শিক্ষামন্ত্রী।

মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রথম শ্রেণির কোনো কর্মকর্তাকে পদায়নে তার যে ক্ষমতা ছিল তাও ছেঁটে ফেলা হয়েছে। ফলে এ রকম চেয়ার সর্বস্ব সচিবে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। মন্ত্রীর অগোচরে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রকাশের পর শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খানসহ মন্ত্রণালয়ের দপ্তর প্রধানদের নিয়ে এমনই একটি নির্দেশনা জারি করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এর ফলে সচিব পর্যায়ে যেসব ফাইল অনুমোদন হত তা বাধ্যতামূলকভাবে তা মন্ত্রীর কাছে পাঠানোর নির্দেশ জারি করা হয়। মন্ত্রীর সায় মিললেই অনুমোদন জুটতো।

গত ২৬ অক্টোবর গোপনীয়ভাবে নিজের একান্ত সচিব নাজমুল হক খানের স্বাক্ষরে এই লিখিত নির্দেশনা জারি করেন শিক্ষামন্ত্রী; যা মন্ত্রণালয়ের সব দপ্তর প্রধানদের পাশাপাশি সচিবকে অবহিত করতে তার একান্ত সচিবকে অনুলিপি দেয়া হয়েছিল। শিক্ষা আইনের খসড়া প্রকাশ নিয়েও মন্ত্রী-সচিবের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। মন্ত্রীকে না জানিয়ে মতামত নিতে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে খসড়াটি প্রকাশ করা হয়েছিল। খসড়াটি যুগোপযোগী নয় বলে সমালোচনা ওঠে। পরে মন্ত্রীর নির্দেশে খসড়াটি প্রত্যাহার করা হয়।

গত ২৬ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রীর একান্ত সচিব নাজমুল হক খানের স্বাক্ষরে লিখিত নির্দেশনা জারি করা হয়। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যে কোনো পরিপত্র, নীতিমালা, আইন ইত্যাদি জারি, জনমতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শন এবং মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অধিদপ্তর বা দপ্তর ও শিক্ষা বোর্ডগুলো প্রথম শ্রেণীর যে কোনো পদে পদায়নের ক্ষেত্রে মন্ত্রী পর্যায়ে অনুমোদন গ্রহণের জন্য মাননীয় মন্ত্রী সদয় নির্দেশনা প্রদান করেছেন। সে মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সবিনয় অনুরোধ করা হলো।’

মতামত ও পরামর্শ নিতে গত ১৯ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রকাশ করা হয়। ২৭ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, খসড়াটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পরিমার্জনের জন্য প্রত্যাহার করা হয়েছে।

খসড়া আইনের প্রশ্নফাঁসের শাস্তিসহ কিছু বিষয় যুগোপযোগী হয়নি বলে খসড়াটির সমালোচনা করেন কেউ কেউ। কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস বা এর সঙ্গে জড়িত থাকলে সর্বোচ্চ চার বছরের কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভদণ্ডের কথা বলা হয়েছিল প্রকাশিত খসড়া শিক্ষা আইনে।

গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আসেন সচিব নজরুল ইসলাম খান। সচিবের বিরুদ্ধে মন্ত্রীকে অবহিত না করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বার বার। সর্বশেষ চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর অবসরে যান এআই খান খ্যাত নজরুল ইসলাম খান।

সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রত্যাখানের যে ধারা তৈরি হয়েছিল শিক্ষাক্ষেত্রে এটা ব্যক্তিগত নাকি শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের জন্য এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন, এখনো সে পুরানো কলেই ধান ভানে আমাদের শিক্ষামন্ত্রণালয়। শিক্ষার উন্নয়নে যেমন সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। তেমনি শিক্ষার জন্য ক্ষতিকর এমন আইন যেন বাতিল করাও জরুরি।


শেয়ার করুন