জাতির কাছে আমার একটি বিচার..!

শিক্ষক দিবসে প্রভাষক ছেলের আর্তনাত শিক্ষক বাবার প্রতি

কাটাখালী দাখিল মাদ্রাসা টেকনাফ এ ১৯৯০ সাল থেকে আমার বাবা বিনামূল্যে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি বছর একনাগাড়ে শ্রম দিয়ে এসেছেন। (৯০ সনে ইবতেদায়ী ছিল, ২০০১’র পরে দাখিল স্তরে উন্নীত হয়)। প্রায় ৩.৬ কি.মি পাহাড়িয়া ঘনজঙ্গল পাড়ি দিয়ে আমার বাবা মাদ্রাসায় যাওয়া-আসা করতেন।
আমি ৪র্থ শ্রেণি থেকে দাখিল পর্যন্ত আমার বাবার সাথে এসে-যেয়ে প্রাণাধিক প্রিয় এই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৮ সনে আমার ব্যাচের সবার থেকে বেশি সিজিপিএ নিয়ে পাশ করেছিলাম।

কিছুদিন আগে প্রতিষ্ঠানটি এমপিও হয়েছে। আমার বাবার NID কার্ডের বয়সের সাথে জন্মনিবন্ধন এবং একাডেমীক সনদের তারতম্য থাকায় আমরা এফিডেফিটের আবেদন করেছি। (জন্ম নিবন্ধন এবং সার্টিফিকেট অনুসারে সাধারণত NID হতে হয়)।
আমার বাবা অত্যন্ত কষ্ট নিয়ে প্রতিটা দিন একবার করে মাদ্রাসা সভাপতির বাড়ি গিয়েছেন, একবার করে মেম্বারের বাড়ি গিয়েছেন এ ব্যাপারে কোন সাহায্য পান কিনা এই আশায়। আমি আমার পিতৃতুল্য শ্রদ্ধেয় ছিদ্দিক হুজুরকে বেশ কয়েকবার জানিয়েছিলাম যে, এই এমপিওতে NID কার্ডের এফিডেফিট গ্রহণযোগ্য।(তিনি আমার বাবাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন)।
আরো বলেছিলাম, যদি আপনারা তারপরেও আমার বাবাকে বাদ দেন অসুবিধে নেই। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে আমার পরিবারের কাউকে নিয়েন।

সত্যিই উনারা কেউই আমার বাবাকে বিন্দুমাত্র সাহায্য তো করেন নি। বরং সবাই একাউন্ট খুলে কাগজ সাবমিট করে ফেলেছেন অথচ আমার বাবা কিছুই জানেন না দেখে সেদিন আমার বাবার মুখে কালো মেঘের ছায়া দেখে আমি নিজে স্থির থাকতে না পেরে সম্মানিত সভাপতি আমার নানু হারুন রশিদ সিকদারকে ফোন করে বলার পর তিনি একাউন্ট খুলতে বলেছেন। (অথচ এর একদিন আগে একাউন্ট খোলার লাস্ট ডেইট চলে গিয়েছিল?!)

আমার বাবা তড়িঘড়ি করে একাউন্ট খুলতে গিয়ে দেখে আমার বাবাকে সংযুক্তি দলিলের কিয়দংশ কাগজ দেওয়া হয়নি। আবার সেসব সংগ্রহ করে একাউন্ট খুলেছেন। আমার বাবা প্রতিটা মুহুর্ত আশায় দিনাতিপাত করেছেন ত্রিশটা বছর বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দেওয়ার ফসল পাওয়ার আশায়!

কিন্তু আফসোস! আমার বাবার নাম এমপিও লিস্টে আসেন নি। কিন্তু এই লিস্টে এমন কতিপয় লোক এসেছে যারা একদিনের জন্যও মাদ্রাসায় পা রাখেন নি?! (আমার বাবাকে বাদ দিয়েছে বলে এতদিন আমরা শুধুমাত্র মহা শক্তিধর রাজার রাজাকে একটা নালিশ দিয়ে রেখেছিলাম স্রেপ!)

যাই হোক, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হলো। (আমাদের পক্ষ থেকে আগে থেকেই রিকুয়েস্ট ছিল দপ্তরী পোস্টে যেন আমাদের পরিবারের/ আত্মীয় কাউকে নেওয়া হয়। (এসব পোস্ট গুলি সম্পূর্ণই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের অধীনে।)
অথচ ঐ পদে নেওয়ার জন্য আমার এক ক্লাসমেটকে প্রস্তাব করেছেন। হায় আফসোস! আমার বাবা ত্রিশটা বছর ধরে শ্রম দিয়েও কি উনাদের বিবেকে একবারও আসেন নি যে, এই লোকটার পরিবার থেকে কাউকে নেওয়া উচিত! আমার প্রতিটা শিক্ষক আমার সারাটা জীবনের জন্য মাথার তাজ। (আমি নিজেও কলেজের একজন প্রভাষক, আমি শিক্ষকের মর্যাদা কতটা বেশি সেটা ভালো করেই জানি!) আমি প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষককে আমার বাবার চেয়েও বেশি সম্মানের চোখে দেখি। বাংলা ভাষার প্রথম ও সবচে’ প্রাচীন কবি শাহ্ মুহাম্মদ সগীরের ভাষায়—

“ওস্তাদে প্রণাম করো-
পিতা হন্তে বাড়ো;
দোসর জনম দিল তীহ সে আম্মার!”

যদি উনারা বলেন যে, আমরা কেন ফোন করে প্রস্তাব করবো? যদি তাই হয় অন্য কাউকে যে ফোন করে প্রস্তাব দিয়েছেন আপনারা সেটা কি করে সম্ভব হলো!? তাছাড়া ত্রিশটা বছর যে লোকটি প্রতিষ্ঠানে ছিল তাকে কি ফোন করাটা বড় বেশি অসম্মানের হতো বা গায়ে লাগতো আপনাদের!

উল্লেখ্য, বর্তমানে যিনি সুপার হয়েছেন, তিনিও আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। তিনি দু’দুবার মাদ্রাসা থেকে দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। একবার সভাপতি কর্তৃক আজীবনের জন্য। (একই সভাপতি কর্তৃক পুনরায় তাকে সুপার হিসেবে এমপিও করা হয়েছে?), অন্যবার ডিসি স্যার কর্তৃক স্থায়ীভাবে!( অথচ তিনি বর্তমানে সুপারিন্টেনডেন্ট।)
[ডকুমেন্ট ছবিতে দেখুন]

জাতির বিবেকের কাছে একবার আমার আর্জিটা রইলো?

লেখক,
সানা উল্লাহ মোঃ কাউছার,
প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ,
ধুরুং কলেজ, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার।


শেয়ার করুন