শক্তি প্রয়োগেই সমাধান খুঁজছে সরকার

imgres67আমাদের সময়.কম:
রসমৎবংদীপক চৌধুরী : সংকট নিরসনের জন্য দেশি-বিদেশি কূটনীতিবিদ, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার আলোচনা চাইলেও চলমান পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে সংলাপ-সমঝোতার বিষয়ে দেশি-বিদেশি কোনো আহ্বানই বিবেচনায় নিতে রাজি নয় সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে শক্তি প্রয়োগেই সমাধান খুঁজছে সরকার।
সর্বশেষ গতকাল বুধবার সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশ থানায় গেলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হবে এবং তার অফিসেও তল্লাশি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আইন তার আপন গতিতে চলবে। যিনি যে অপরাধ করেছেন, আইন মোতাবেক তার বিরুদ্ধে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেদিন বেশি দূরে নয়। আদালত খালেদা জিয়ার কার্যালয় তল্লাশির নির্দেশ দিয়েছেন।
সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংকট উত্তরণে সরকার সংলাপ বা আলোচনার কথা ভাবছে না। তারা যদি খুঁজতো বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের সঙ্গে আলোচনা করতো তাহলে আলামতও ভিন্নরকম হতে পারতো।
আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা জানান, জাতিসংঘের মহাসচিব ও ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্রয়োজনে সহযোগিতা দেওয়ার কথা বললেও আমরা তাদের সহযোগিতা চাইব না। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মহাসচিব। তবে তারানকোর বাংলাদেশে আসা অনেকটাই অনিশ্চিত। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারানকোকে মধ্যস্থতার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে না। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও শিগগিরই বাংলাদেশে আসবেন না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদিও এবারের স্বাধীনতা দিবসে আসবেন না।
সরকার যে কত কঠিন ও কঠোর হচ্ছে এর নমুনা হলোÑ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৪টি মামলা দায়ের হয়েছে। শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ৮৩টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৫৩, মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ২৩, শমসের মবিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৬ ও সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা হয়েছে। দলটির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ও কেন্দ্রীয় বেশিরভাগ নেতার বিরুদ্ধেও নাশকতার মামলা রয়েছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া শুরু হয়। সারা দেশে নাশকতার অভিযোগে জোটের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলার সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। আসামি করা হয়েছে জোটের প্রায় সাড়ে চার লাখ নেতা-কর্মীকে। বিএনপির আইনজীবী ও পুলিশ সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে চলতি বছরের টানা হরতাল-অবরোধ চলাকালে সারা দেশে মামলা হয়েছে প্রায় ৯শটির মতো। ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, গত দুই মাসে ঢাকা মহানগরে মামলা হয়েছে ৩২৫টি।
আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচনা করে বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, দলটি মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেও তারা বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করছে। আমরাই শুধু নই, সারাবিশ্ব এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান কামনা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ করছে উল্টোটা।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে আলোচনার আহ্বান জানালেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সব সময় আলোচনা-সংলাপ এড়িয়ে গেছে। কিন্তু কঠিন সত্য এটিই এদেশের জšে§র পর থেকে সৃষ্ট বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে সব রকম রাজনৈতিক সংকট বা সমাধানের পথ এদেশের জনগণই খুলে দিয়েছে, বিদেশি কূটনীতিকরা নয়।
আলোচনা বা সংলাপের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার অতীব দরকারের জবাবে ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র একাধিক নেতা ও মন্ত্রী চলমান সংকটের আগের বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ করেন।
দলের উপদেষ্টা পরিষদের আরেকজন সদস্য জানান, ২০১০ সালে সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সদস্যদের নিয়ে সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিদের রাখার জন্য নাম চাওয়া হয়। বিএনপি তখন সংবিধান সংশোধন কমিটিতে যায়নি। এরপর এই কমিটি সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করার আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মতামত নেয়। ওই সময় বিএনপির সঙ্গেও আলোচনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তখনও বিএনপি সাড়া দেয়নি।
আওয়ামী লীগ নেতা ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, আলোচনার জন্য সর্বাÍক চেষ্টা চালানোর নজিরও রয়েছে আওয়ামী লীগের। এরপরও বিএনপি জোট ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর ঘোষণা দিয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্য দিয়েই চলমান সহিংসতা বন্ধ করতে চায় সরকার। প্রবীণ এই রাজনীবিদ বলেন, ককটেল মেরে বা পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ মারা আর আন্দোলন করা এক কথা নয়। অতীতের মতো সন্ত্রাস সহিংসতা নাশকতা মোকাবিলায় এতে নেওয়া প্রশাসনিক ও আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
নীতিনির্ধারক পর্যায়ের আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, সহিংস পরিস্থিতি সামাল দিতে নমনীয়তা দেখানোর আর কোনো পথ সরকারের সামনে খোলা নেই। যেসব ধারাবাহিক ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি বর্তমান পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে।
ওয়ার্কার্স পার্টির একজন নেতা জানান, বিএনপিকে বারবার আলোচনার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে, চলমান পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগও সরকার দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে আন্দোলনের নামে সহিংতার পথ বেছে নিয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে ‘আগে সহিংসতা বন্ধ করার’ আহ্বান জানানো হয়েছে বিভিন্ন সময়। সহিংসতা বাদ দিলেই কেবল সংলাপ হতে পারে বলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে জানানো হয়। কূটনীতিকদের পক্ষ থেকেও সমঝোতার জন্য সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু টানা কর্মসূচির পাশাপাশি সহিংসতাও অব্যাহত রয়েছে।
১৪ দলের একজন সিনিয়র নেতা জানান, সংলাপ হবে এমনটা অনেকেই বিশ্বাস করছেন না। ফলে সরকার শক্তি দেখিয়েই বিএনপিকে ‘দুর্বল’ করতে চায়।
চলমান পরিস্থিতি ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, তাদের সঙ্গে বারবার আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে ফোন করেছেন। এসবই দেশের মানুষের জানা। এরপর আমাদের আর কি উদারতা দেখাতে হবে?
১৪ দলের একজন সিনিয়র নেতা জানান, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন ঠেকাতে টানা অবরোধ হরতাল দিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে বিএনপি-জামায়াত জোট। তাদের কর্মসূচিতে যানবাহনে আগুন, বোমাবাজি, ভাঙচুরের ঘটনায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহƒত ৫ শতাধিক স্কুল জ্বালিয়ে দেয়। তবে নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয় বিএনপি।
মাঝখানে একবছর কেটে গেল, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারিতে সৃষ্টি হলো আরেক ইতিহাস। অনেকেই এরপরের কাণ্ডকারখানা জানেন, সন্ত্রাস ও পেট্রলবোমার ইতিহাস আমাদের বার্ন ইউনিটের সাক্ষী। দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ১৬৮ জন। নৃশংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ১২০ জন। পেট্রলবোমায় মারা গেছেন ৬৯ জন। সেদিকে যাবো না, যেতে চাই না। কারণ, সেকথা অনেকেই জানেন। কিন্তু শেখ হাসিনা এ কৌশল অবলম্বন করতেন, না। রাজনীতির মতো কঠিন খেলা সবাই খেলতে জানেন না।


শেয়ার করুন