লোকসানে দিশেহারা বোটমালিক-জেলেরা

Fish-News-Picশাহেদ ইমরান মিজান : সাগরে মাছের আকাল, দস্যুতা ও দুর্যোগের কারণে বিরাট লোকসান গেছে বোটমালিক ও জেলেদের। সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে এই লোকসান গেছে। বিগত তিন বছর ধরে লোকসান হয়ে আসলেও শেষ মৌসুমে লোকসানের পরিমাণটা বেড়েছে অনেক। লোকসানে পড়ে বোটমালিকদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। একই সাথে জেলেদেরও চলছে দুর্দিন। কোন ভাবেই অবস্থার উত্তরণ দেখা না যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।
বোট মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বিগত তিন বছরে সাগরে মাছের তীব্র আকাল বিরাজ করছে। সেই সাথে জলদস্যুদের ভয়ংকর তা-ব ও প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় নানা দুর্যোগ বিরাজ করছে। এসব কারণে মৎস্য উৎপাদনে  প্রকট সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে মাছের সংকট অন্যদিকে বেড়ে গেছে মৎস্য আহরণ খরচ। ফলে লোকসানের অংক বেড়েছে।
সূত্র মতে, সেপ্টেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত মাছধরা মূল মৌসুম। এই সময়ে অনেকটা নির্বিঘেœ মাছ ধরা যায়। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে সাগরে দস্যুদের তা-ব ভয়ংকর ভাবে বেড়ে গেছে। দস্যুরা বোট, জাল ও মাছসহ সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যায়। তারপরও ক্ষান্ত হয় না তারা। মুক্তিপণের উদ্দেশ্যে জেলেদেরও অপহরণ করে। এতে মৎস্য  আহরণে চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অজ্ঞাত কারণে বিগত তিন বছর ধরে সাগরের মাছের আকাল চলছে। একই সাথে বছরে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ চলছে। বিগত তিন বছরে মহাসেন, কোমেন ও রোয়ানুর মতো তিনি বড় ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। এসব ঘূর্ণিঝড়সহ নানা দুর্যোগে পড়ে বোট ডুবিসহ নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। হয়েছে জেলেদের প্রাণহানিও। এতেও একটা বিরাট লোকসানের মুখে পড়ে বোটমালিক ও জেলেরা।
বোট মালিক সূত্রে জানা যায়, একটি ইলিশ বোটে ১৫ থেকে ১৮ জন জেলে প্রয়োজন। বিহিঙ্গি জালের বোটে ২০ থেকে ৩০ জন। বিহিঙ্গি জালের বোটে মৌসুম ভিত্তিক জেলে নিয়োগ দেয়া হয়। মৌসুমে একজন জেলে নিয়োগ দেয়া হয় ৮০ থেকে ১ লাখ টাকা। মাঝি ২ লাখ টাকা। মাছ আহরণ যাই হোক তাদের চুক্তিমাফিক টাকা পরিশোধ করতে হয় বোট মালিকদের। এই ধারায় বোটমালিকরা বিরাট চাপে থাকেন। এতে লোকসান হলে বোট মালিককে একাই বহন করতে হয়। তবে আরেকটি নিয়মে কমিশন ভিত্তিক জেলে নিয়োগ করা হয়। এর নিয়ম হচ্ছে, ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিশনের জেলেরা মাছ আহরণ করেন। এই পদ্ধতিতে লাভ-লোকসান বোটমালিক ও জেলেদের সমান ভাবে বহন করতে হয়।
জেলা বোট মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারে সাড়ে ৫’শ বেশি মাছ ধরার বোট রয়েছে। তার মধ্যে সমিতিভুক্ত রয়েছে সাড়ে প্রায় ৩’শ বোট। এছাড়াও আরো ২’শ বোট বিচ্ছিন্ন ভাবে রয়েছে। কিন্তু টানা তিন বছর ধরে টানা লোকসানে পড়ে অনেক বোট কমে গেছে। অনেক বোট পরিত্যক্ত পড়ে আছে। পরিত্যক্ত থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে গেছে অনেক বোট।
জেলা বোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ জানান, সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে একেকটি বোটকে ১০ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুণতে হয়েছে। অধিকাংশ বোটেই লোকসান হয়েছে। লোকসান গুণতে গুণতে পথে বসে গেছে অনেক বোট মালিক।
তিনি জানান, নুনিয়াছড়ার আবদুল হক কোম্পানি ১০টি বেশি মাছ ধরার বোট রয়েছে। সব গুলোতেই তার লোকসান হয়েছে। শেষ মৌসুমে তিনি এক কোটি টাকার মতো লোকসান দিয়েছেন। লোকসানের কারণে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে গেছেন। ঋণ শোধ করতে তিনি নুনিয়াছড়ায় ১০ ঘন্টা জায়গা বিক্রি করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তার আরো অনেক বোটমালিক বিরাট লোকসান গুণেছেন। লোকসানের কারণে অনেকে বিক্রি করে দিচ্ছে বোট। এরই মধ্যে নুনিয়াছড়ার আবু সোলতান নাগু, আবু ছৈয়দ কোম্পানি ২০টি বোট বিক্রি করে দিয়েছেন। জেলা বোটমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক দু’টি বোট বিক্রি করে দিয়েছেন। এক সময় সভাপতি মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যানে বাবার ১৪টি বোট থাকলেও বর্তমানে একটিও নেই। টেকপাড়া আমির হোসেন, জয়নাল আবেদনী, জয়নাল আবেদনী খাজার মতো বোট ব্যবসায়ী সব বোট বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। লোকসানের কারণে বোটমালিক ও জেলেরা অর্থের ভিখেরিতে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের ধণাঢ্য বোটমালিক ও জেলেরা এখন খুচরা আকারে পাঁচ কেজি চাল কিনে। ডাল-সবজি দিয়ে আহার করেন।
জেলেদের দাবি মতে, মাছের আকালে মধ্যে প্রধান কারণ ট্রলি জাহাজ। তারা নির্বিচারে সাগরের মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে মাছের প্রজননের। কেননা জাহাজে আটকা পড়া ছোট মাছগুলো আর বাঁচে না। একই সাথে মাছধরায় নিষিদ্ধ সময়গুলো মাছের আকালের জন্য দায়ী করছেন জেলেরা। কেননা ওই সময় দেশীয় জেলে মাছধরা থেকে বিরত থাকলেও বিদেশী বড় বড় ট্রলিগুলো ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যায় অগোচরে। এটাও মাছের আকালের জন্য আশঙ্কাজনক। অন্যদিকে কোস্টগার্ড হয়রানির কারণে চরম দুর্দশায় আছে জেলেরা। লাইসেন্সের নামে হয়রানি, অবৈধভাবে টাকা আদায়, মাছ কেড়ে নেয় কোস্টগার্ড।
জেলা বোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ বলেন, ‘আগে মাছের টাকা দিয়ে কক্সবাজার শহর বিভিন্ন স্থানে জমি কিনে বহুতল ভবন গড়েছেন বোট মালিকরা। এই রকম অনেককে পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই দিন এখন স্বপ্ন শুধু। কারণ এখন বহুতল ভবনতো দূরের কথা যা ছিল তা বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। বোট মালিকদের কোন ধরণের সরকারি আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হয় না। তাই দাদন ব্যবসায়ী থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। দাদনের টাকা শোধ করতে করতে নি:স্ব হয়ে যাচ্ছে বোট মালিকরা।’
কক্সবাজার মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন এর ব্যবস্থাপক মো: শরিফুল ইসলাম জানান, মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের রেকর্ড মতে আমাদের রাজস্ব বেশি হয়েছে। তবে তাতে সাগরের মাছের পরিমাণ গত বছরের চেয়ে কমছিল। মূলত রাজস্ব বেড়েছে ঘেরের মাছ দিয়েছে। সামগ্রিক ভাবে বলা যায়, সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে সাগরের মাছ আহরণের পরিমাণ কমেছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কক্সবাজারের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এহসানুল করিম বলেন, ‘দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে মাছ সাগরের দূর সীমানায় চলে যায়। মনে করা হচ্ছে কয়েক বছর ধরে টানা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কক্সবাজার উপকূলের মাছ দূরে সরে গেছে। একই সাথে ভূমিকম্পের প্রভাবেও মাছগুলো গভীর সমুদ্রে চলে যায় এবং তাদের গতিপথ পরির্বতনসহ অনত্র চলে যায়।’
জেলা বোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান বলেন, ‘মাছের আকাল, দস্যুতাসহ নানা কারণে বোটমালিকরা আজ পথে বসেছে। অনেকে পেশা ছেড়ে দিয়েছে। সবাই নি:স্ব। এ পরিস্থিতিতে একমাত্র উপায় সরকারি সহযোগিতা। সরকার বিনা সুদে বোট মালিকদের লোন দিলে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে আমি মনে করি।’


শেয়ার করুন