লায়লাতুল কদরের ফজিলত ও তাৎপর্য

imagesহাফেজ মাওঃ মোঃ বজলুর রহমান:

লাইলাতুল কদরকে উর্দূ ও ফার্সিতে সবে কদর বলে। সব অর্থ রাত। কদর অর্থ সম্মান। সুতরাং সবে কদর অর্থ সম্মানিত রাত। আবার কদরের অন্য অর্থ হচ্ছে তাকদির। এ শব্দটি ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। অতএব, শবে কদরের অনেক গুরুত্ব ও বৈশিষ্ঠ্য রয়েছে। এ রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ পাক পূর্ণাঙ্গ ‘‘সূরা কদর’’ নাযিল করেছেন। এই সূরায় আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘ নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাযিল করেছি মহিমান্বিই রাতে। সবে কদর সম্পর্কে আপনি জানেন কি? শবে কদর হলো হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেস্তারাও রুহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালন কর্তার নিদের্শক্রমে। এটা নিরাপত্তা যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে’’।

শবে কদরের ইতিকথা: একদিন রাসূল (সঃ) বনি ইসরাইলের চারজন অবেদের কথা বলেন, যারা ৮০ বছর পর্যন্ত নিরলস ভাবে আল্লাহ পাকের ইবাদতে রত ছিলেন। ঐ সময়ে এক মুহুর্তের জন্যও আল্লাহ পাকের হুকুমের বরখেলাপ করেননি। উক্ত চার জন অবেদ হলেন, হযরত আয়ুব (আঃ), হযরত জাকরিয়া (আঃ), হযরত হিজকিল (আঃ) এবং হযরত ইউশাবিন নুন (আঃ)। রসূল (সঃ) এ কথা শুণে সাহাবায়েকেরাম খুবই আশর্যান্বিত ও বিচলিত হলেন যে তাদের পক্ষে এতা ইবাদত করা সম্ভব নয়। কারণ আখেরী নবী উম্মত ৬০-৭০ বছরের মধ্যে ইন্তেকাল করেন। কাজেই তাদের সমান বয়স না পাওয়ায় এতো ইবাদত করা সম্ভব নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক ‘‘সূরা কদর’’ নাযিল করে সাহাবায়েকেরাম শান্তনার বাণী শুনিয়ে ছিলেন। আল্লাহ পাক বলেন, শবে কদরের ইবাদত ১ হাজার মাসে ইবাদতের চেয়েও বেশি বরকতময় ও শ্রেষ্ঠ। এ রাতেই প্রথম কোরআন নাযিল হয়। এ রাতে হযরত জিব্রাইল (আঃ) অগনিত ফেরেস্তারা নিয়ে ধরা পৃষ্ঠে অবতরণ করে বিস্ববাসীর জন্য অসংখ্য কল্যাণ ও প্রাচুর্য বিতরণ করেন । এ রাতে আল্লাহর মাহবুব বান্দরা অবর্নণীয় আন্তরিক শান্তি অনুভব করেন। এ রাতে অবিরাম ধারায় আল্লাহ তা’য়ালার রহমত ও বকরত বিশ্ববাসী ও মুমিনদের অন্তরে নেমে আসে। আল্লাহ পাক অসংখ্য পাপীকে ক্ষমা করে থাকেন। এ রাতে তওবা কবুল হয়। আসমানের সমস্ত দ্বার খুলে দেওয়া হয়। এ রাতে গরম ও শীত কোনোটি বেশি অনুভূত হয় না। ফজর পর্যন্ত নক্ষত্র অটুট থাকে। সূর্য উদয় কালে প্রখরতা থাকেনা ও সূর্য উদয় কালে শয়তান উপস্থিত থাকে না। এতএব পবিত্র রমজান মাসে শেষ ১০ দিনে বেজোড় রাত গুলোতে শবে কদরকে অনুসন্ধান করতে হয়। অর্থাৎ ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ও ২৯ তারিখ রাত সমূহে শবে কদর ঘটে থাকে। রসূল (সঃ) বলেছেন তুমি যদি চাও তোমাদের কবর নূরের দ্বারা উজ্জ্বল হোক, তাহলে শবে কদরের রাত্রে ইবাদত কর। যে ব্যক্তি শবে কদরের রাতকে জিন্দা রাখে কেয়ামতের দিন তার দিল মুরদা হবে না। বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি শবে কদরকে জিন্দা রাখে, সে ১০০ বছর ইবাদত করার সওয়াব পাবে। তবে ২৭ রমজান শবে কদর ঘটার পক্ষে অনেকে মত প্রকাশ করেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, ৭ সংখ্যার মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে: যথা (১) আল্লাহ পাক আসমান বানিয়েছেন ৭টি (২) জমিনও ৭ পরণ (৩) সাফা ও মারওয়াতে সায়ী করতে হয় ৭ বার (৪) কা’বার তাওয়াব করতে হয় ৭ বার (৫) শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করতে হয় ৭বার (৬) মানবকে সৃষ্টি করেছেন ৭ পর্যায়ে।

(এক) মৃত্তিকার সারংশ (দুই) শক্রু (তিন) জমাট রক্ত (চার) মাংস পিন্ড (পাঁচ) অস্থি পিঞ্জির (ছয়) অস্তিকের মাংস দ্বারা আবৃতকরণ (সাত) রুহ সংযুক্তকরণ (আট) কোরআনের কেরাত ৭ প্রকার (নয়) নামাজের সেজদাহ ৭ অঙ্গ দ্বারা করা হয়। (দশ) দোযখের সংখ্যা ৭টি (এগার) কোরআনের আল্লাহ পাক ৭ বার কসম খেয়েছেন। কোরআন শরীফে ৯৭নং ‘‘সূরা কদর’’ এ কদর শব্দটি তিনবার বলা হয়েছে। এ সূরায় লায়লাতুল কদর লিখতে ৯টি অক্ষর লাগে। এ ৯ সংখ্যাটিকে উক্ত ৩ দ্বারা গুন করলে ২৭ সংখ্যাটি দাঁড়ায়। উক্ত ৯৭ ও ২৭ সংখ্যা ২ এর মধ্যেও ৭ সংখ্যাটি সংযোগ হয়ে সাতের গুরুত্ব বহন করেছে। অন্যান্য বড় বড় পবিত্র রাতের তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। কিন্ত শবে কদরের তারিখ নির্ধারিত নেই। তাই রমজানের শেষ ১০দিন বেজোড় রাত সমূহের মধ্যে লায়লাতুল কদর তালাশ করতে হয়। আমাদের কথা হলো ৭নিয়ে, তাই বলছি, ২০ এর সংঙ্গে ৭ যোগ করলে ২৭ হয় এই জন্য আমাদের ধারণা শবে কদর ও রমজানের ২৭ রাতে ঘটে থাকে।হযরত উবাইদ বিন ওমর (রাঃ) বলেছেন, আমি ২৭ রমজান শবে কদরের সুর সাগরে জাহাজে চড়লাম । যকন সাগরের পানির স্বাদ গ্রহণ করি, তখন দেখি , পানি খুবই মিষ্টি । আর জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। আর দেখলাম সমস্ত বৃক্ষ সেজদায় পড়ে আছে। শবে কদর যখন ঘটবে, তখন কিছু আলামত উপলদ্ধি করা যায়। লাখ লাখ ফেরেস্তা যারা নাজিল হয়েছেন তারা সব ইবাদতকারীর সঙ্গে মোসাফাহা করেন। তখন অন্তরে খুশ অনুভ’ত হয়। শরীরের লোম খাড়া হয়। চোখ দিয়ে অশ্রু বের হয়। তখন দোয়া ও কবুল হয় । তবে হযরত ইবনে মাসউদ বলেছেন, যে ব্যক্তি সারা বছর জাগ্রত থেকে রাতে ইবাদত করে, সে অবশ্যই শবে কদর লাভ করবে। তাই ওলামায়েকেরামদের অভিমত হলো, রমজানের শেষ ১০ দিন ই’তেকাফ পালন করে যেন শবে কদর তালাশ করা হয়। হযরত আবুহুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেন, যদি তোমরা কবরকে আলোকময় পেতে চাও তাহলে লাইলাতুল কদর জাগ্রত থেকে ইবাদত কর । (মিশকাত ও বাইহাকি) রাসুল (সাঃ) আরো ইরশাদ করেন তোমরা লাইলাতুল কদরকে মাহে রামজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত সমুহে তালাশ কর, (বুখারি শরিফ)। হযরত উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন,রমজানের ২৭ তারিখের রাত্রের ভোর পর্যন্ত ইবাদত বন্দেগী আমার কাছে সারা রামজানের অন্য সব রাত্রের ইবাদত অপেক্ষা অধিক প্রিয়, (তিরমিযি)।

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেল কিন্তু ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে কাটাতে পারলনা তার মত হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই । রাসুল (সাঃ) আরো ইরশাদ করেন, যেলোক শবে কদর থেকে বঞ্চিত হয়, সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপুর্ণ বঞ্চিত হল, (ইবনে মাজাহ)। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা আমি রাসুল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম , হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমি যদি কদরের রাত সর্ম্পকে অবহিত হতে পারি, তবে আমি কি করব ? তখন রাসুল (সাঃ) আমাকে বললেন,তোমি একটি দোয়া পাঠ কর । সেই দোয়াটি হল, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি । তাই সারা রাত জাগরণ থেকে সঠিক ভাবে ইবাদত বন্দেগীতে মনোনিবেশ করা সকলের জন্য একান্ত কর্তব্য । বেশী বেশী নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, সালাতুস তাসবীহ, উমরী কাযা নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, দান-সাদকা, যিকির-অযকার, তাসবীহ-তাহলীল, তাওবা-ইসতেগফার, দোয়া দরুদসহ ইত্যাদি নফল আমলের প্রতি মনোযুগি হওয়া একান্ত জরুরী। আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে বিদআ’ত ও কুসংস্কার মুক্ত বিশুদ্ধ ইবাদত ও আমল করার তাওফীক দান করুন, আমিন চুম্মা আমিন।

খতিব ইউছুপের খীল নূর জামে মসজিদ

ইসলামাবাদ, সদর কক্সবাজার।


শেয়ার করুন