লামায় স্ত্রী হত্যার ঘাতক স্বামী জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে

63803d77-aa22-45c2-8b17-da5c7a80a2a5এম.বশিরুল আলম লামা 

৩০ অক্টোবর ২০১৫ । দিন ব্যপি মাক্যচিং মার্মা পাষন্ড স্বামীর বকাবকি, কারেন্ট শর্ট ও কিল-ঘুষির আঘাত সহ্য করে আসছিল নীরবে। দিনের আলো পুরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে স্বামীরুপি ঘাতকের দানবীয় হামলায় মাক্যচিং মার্মার জীবন প্রদীপ নিবে যাবে, এমনটি ভাবেনি প্রতিবেশিরা। এই বর্বরচিত ঘটনার পরদিন থেকে হত্যাকারীর ফাঁসির দাবীতে রাজপথে স্বোচ্ছার হন শিক্ষক মহলসহ এলাকার সর্বস্তরের মানুষ। ১১ জানুয়ারি ২০১৬ থোয়াই শৈ মার্মা জামিনে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর আলো বাতাশে। এদিকে মাক্যচিং-এর আত্মা হয়তো চিৎকার করছে সু- বিচারের আহবানে। এই নিষ্ঠুর হত্যার বিচার পাবেকি ম্যক্যচিং মার্মার পরিবার (?) না কি আইনের ফাকগলে পার পেয়ে যাবেন হত্যাকারী, এমন প্রশ্ন সকলের।
বান্দরবানের লামায় স্কুল শিক্ষিকা মাক্যচিং মার্মা (২৮) এর হত্যাকারী ঘাতক স্বামী থোয়াই শৈ মার্মা (৩২) ২ মাস ১১ দিন জেল খেটে এখন জামিনে মুক্ত। বিয়ের ৪ মাসের মাতায় হাতের মেহেদী রং শুকানোর আগেই ঘাতক স্বামীর দা’র কোপে রক্তে রঞ্জিত মাক্যচিং মেজোতে লুটিয়ে পড়েছিল। মাক্যচিং-এর বাঁচার আকুতি বুঝতে পারেনি প্রতিবেশি বা নিকট আত্মীয়রা। এর আগে ছোট ছোট নিষ্টুর আচরণ গুলো ঈঙ্গিত করেছিল যে, এক সময় স্বামীর মূখোসপড়া দানবটির হীং¯্র আছড়ে নিবে যাবে মাক্যচিং-এর জীবন প্রদীপ। কখন যে ঘাতকের মস্তিস্কের কোন দখল করেছিল ঠান্ডা মাতায় মাক্যচিংকে হত্যার পরিকল্পনাটি কেউ আঁচ করতে পারেনি। অচেতন- স্বার্থান্ধ সমাজ মাক্যচিংদের বাঁচার আকুতি শুনতে পায়না কখনো। দেশে নারী শিশু নির্যাতন আইনে অনেক বিচার হয়েছে। নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা, হত্যা, এসিড় নিক্ষেপ, ধর্ষন, ইভটিজিং, পাচার ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত হওয়ায় মৃত্যুদন্ড হয়েছে অনেকের। এর মধ্যে আশির দশকে শারমিন রিমা হত্যার আসামী তার স্বামী ডা: মুনির-এর ফাঁসি সংবাদ মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। নারীর অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা সাম্প্রতিককালে অনেক সচেতন ভুমিকা রাখছেন। এই প্রেক্ষাপটে নারীর নিরাপত্তা ও ন্যয় বিচার আশা করে সাধারণ মানুষ।
ce695769-ee26-4424-8492-6293eea232e1লামা পৌর শহরের বড় নুনারবিলপাড়া ৭ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা- স্বর্গীয় উক্যজাই মার্মার মেয়ে মাক্যচিং মার্মা (২৮)। ২০০৫ সালে এসএসসি ও ২০০৮ সালে এইচএসসি পাশ করে। ২০১০ সালে পার্বত্য বান্দরবান জেলা পরিষদের অধিনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। চাকুরীর ১ম বছর রুমা উপজেলায় খামাসা পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলী হয়। সে সুবাধে পরিচয় ও প্রেম হয় বান্দরবান সদর উপজেলার মেঘলা এলাকার তালুকদার পাড়ার চিংসাপ্রু মার্মার ছেলে থোয়াই শৈ মার্মার সাথে। সে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (কারিতাস) এ চাকুরী করতেন। সদা কথা কম বলা-শান্ত প্রকৃতির মাক্যচিং মার্মা শুরুতে থোয়াই শৈ মার্মার প্রেম প্রত্যাখান করে আসছিল এবং এক পর্যায়ে মাক্যচিং প্রেমে পড়ে যায়। ১৯ জুন/২০১৫ সালে সামাজিক রীতি অনুযায়ী তাদের বিয়ে হয়। এরই মধ্যে লামা রুপসীপাড়া একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলী হয় মাক্যচিং। একই সময় পিত্রালয় ছেড়ে লামা পৌর শহরের স’মিল পাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতে থাকে স্বামীসহ। প্রতিবেশি সূত্রে জানাযায়, বিয়ের পর থেকে মানসিক ও শারিরীকভাবে স্বামী কর্তৃক টর্চারের শিকার হয়ে আসছিল মাক্যচিং মার্মা। লোক লজ্জায় বিষয়টি আত্মীয়-স্বজনসহ দশ কান হতে দিতে চাইতেন না সে।
৩০ অক্টোবর/১৫ গয়ণা বা টাকা না পেয়ে সারাদিন মাক্যচিংকে মারধর করেন। স্বামী কর্তৃক ইলিক্ট্রিকশর্টসহ শারিরীকভাবে নিষ্ঠুর আঘাতের যন্ত্রণায় মাক্যচিং চিৎকার করেছিলেন। প্রতিবেশি কয়েকজন যুবক পাষন্ডতার কবল থেকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টাও করেছিলেন। ভেতর থেকে রুমের দরজা বন্ধ করে তাকে শারিরীক নির্যাতন করা হয়। রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে মাক্যচিং এর চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়। পাশের লোকজন এসে দরজা নক করলে, ভেতর থেকে ঘাতক থোয়াই শৈ মার্মা দা হাতে সবাইকে তাড়া করে। ঘটনা জানতে পেরে তার কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ গিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে। পুলিশ ঘটনাস্থলে জবাই করা মাক্যচিং মার্মার রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে এবং ঘাতক নিজেই তার স্ত্রীকে খুন করেছে বলে স্বীকারোক্তি দিয়ে, নিজেই নিজের ফাঁসির দাবী জানিয়েছিল। পুলিশের প্রাথমিক সুরত হাল প্রতিবেদন ও হত্যাকারীর প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি, স্থানীয়ভাবে স্বোচ্ছার হওয়া জনগণের করা থোয়াই শৈ মার্মা-এর দ্রুত বিচার এবং ফাঁসির দাবীটি যথার্থ বলে বিবেচিত হচ্ছে সু-শীল সমাজে। পুলিশ ৩০২ ধারা পেনাল কোর্ড, “ধারালো বটি দ্যা দিয়া কুপাইয়া হত্যা করার অপরাধ” লিপিবদ্ধ করেছেন।
বান্দরবান জেলা সদরের মেঘলা গ্রামের বাসিন্দা থোয়াই শৈ মার্মা স্থানীয়ভাবে একজন বহুরুপি-বদমেজাজি যুবক হিসেবে পরিচিত। সে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে (কারিতাস) সিড়ি প্রকল্পে মাঠ কর্মী হিসেবে লামায় চাকুরি করতেন। সহকর্মিদের সাথে আলাপ করে জানাযায়, সে তার দায়িত্ব পালনেও ছিল খাম-খেয়ালীপনা ও বদ মেজাজি। তার উগ্র স্বভাবের কারণে বান্দরবান থেকে কারিতাসের উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ লামায় বদলী করে দিয়েছিলেন। প্রায়ই সময় নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা উছশৃঙ্খল থোয়াই শৈ মার্মা ছিলেন সন্দেহ প্রভন। জামিনে মুক্ত থাকা এই হত্যাকারী যুবক সমাজের জন্য কখনো নিরাপদ হতে পারেনা বলে দাবী করেছেন তার কর্মস্থলের সহকর্মিরা।
প্রতিবেশিরা জানান, জীবদ্দশায় ৪ মাস ১১ দিন মাক্যচিং মার্মা থোয়াই শৈ মার্মা এর সাথে দাম্পত্য জীবন কাটান। এর মধ্যে ৪ মাসই মাক্যচিং-এর উপর চলছিল মানসিক ও শারিীক নির্যাতন। বিয়ের ১ মাস যেতেই স্ত্রীর সকল অলংকার বিক্রি করে আত্মসাত করে। প্রতিবেশিরা জানান, প্রায়ই সময় নানা বাহানায় স্ত্রীর নিকট টাকা চায়তেন তার স্বামী। হত্যা কান্ডের দিন শুক্রবার মাক্যচিং-এর কাছে টাকা না পেয়ে ঝগড়া শুরু হয়। দিন ব্যাপি বদ্ধঘরে নির্যাতনের এক পর্যায় সন্ধ্যায় দা-দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে মাক্যচিং মার্মাকে। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে লামা থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ সিরাজুল ইসলাম ও এস আই অভিজিত ঘটনাস্থলে পৌছে। স্ত্রীকে হত্যার পর ঘরের মধ্যে সে নিজের দু’হাতে ইলিক্ট্রিক শর্ট দিয়ে আত্ম হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। তৎক্ষণাৎ পুলিশি উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে সে দরজা খুলে দেয় এবং স্ত্রীকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেন। ওই সময় রুমের মেজোতে মাক্যচিং-এর রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশসহ স্থানীয়রা।
এদিকে স্বামী থোয়াই শৈ মার্মা কর্তৃক স্ত্রী মাক্যচিং-এর এই নিষ্ঠুর বর্বরচিত হত্যার বিষয়টি রাত ৯ টার পর জানাজানি হলে, উত্তেজিত প্রতিবেশি ও আত্মীয়রা প্রতিবাদ মূখর হয়ে পড়েন। অনেক কষ্টে পুলিশ জনতার রোষণল থেকে ঘাতক থোয়াই শৈ মার্মাকে নিরাপদ হেফজতে নিয়ে যায়। পরদিন থেকে লামা উপজেলার শিক্ষক-জনতাসহ সকল পেশার মানুষ রাজপথে নেমে পড়েন “স্কুল শিক্ষিকা ম্যাক্যচিং মার্মা”র হত্যাকারীর ফাঁসির দাবীতে। এক জন মানুষকে হত্যা করে, হত্যাকারী লোক সমাজে প্রকাশ্য ঘুরে বেড়ানোর করুণ দৃশ্য এবং নিহতের বিরুদ্ধে মিথ্যা বেগানা সম্পর্ক’র দোষারোপ তোলা আরো একটি বড় অপরাধ বলে মনে করেন সমাজ। জানাগেছে, নিজেকে বাঁচানোর মনগড়া কল্প কাহিনী ও হেতু রটাচ্ছেন হত্যাকারী। চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়–য়া নিহতের ছোট ভাই জানান, তার পরিবার এখনো থোয়াই শৈ মার্মা ও এর আত্মীয়দের যে কারো কাছে নিরাপদ নয়। সে জানান, যেকোন সময় হত্যাকারী নতুন করে প্রাণঘাতি ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে পারেন মাক্যচিং-এর পরিবার-আত্মীয়দের বিরেুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে দেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো আইনি সহায়তা প্রদানে নিহতের পরিবারের পাশে দাড়ানোর দাবী উঠেছে স্থানীয়ভাবে। এ ব্যপারে মামলার আইও এসআই অবিজিত দাস জানান, এখনো ময়না তদরন্তর রিপোর্ট আসেনি। রিপোর্ট আসলেই চার্জশীট দিয়ে দেব।


শেয়ার করুন