রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন, কূটনৈতিক ব্যর্থতা

মোজাম্মেল হকঃ

আজ থেকে তিনবছর আগে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং দুই দেশের মধ্যকার বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তাবে আজ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও নিরাপদ প্রত্যাবাসনেরসুযোগ পাইনি বা সম্ভব হয়নি।
ঘর-বাড়ি,ভিটে জমি সহায়- সম্বল হারা রোহিঙ্গারা শরনার্থী শিবিওে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তার উপর করোনাঝুঁকি তো আছেই। তারা দ্রুতনিরাপদ ও মর্যাদাকর প্রত্যাবাসন চায়। ২০১৭ সালের ২৫ শে আগষ্টআরকানরাজ্যের (বর্তমানরাখাইনরাজ্য) কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কর্তৃক হামলার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পরিকল্পিত ভাবে সহিংসতা জোরদারকরে।
হত্যা-ধর্ষন সহ বিভিন œধরনের সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে সাত লাখমানুষ। ৮০ এবং ৯০ এর দশকেপালিয়েআসাআরোতিন থেকে পাঁচলাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে বর্তমানেরয়েছে। সব মিলে ১০ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গাশরণার্থীর বোঝা বাংলাদেশের মত একটিক্ষুদ্র ও অনুন্নত দেশ বয়ে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফ এই বোঝার ভার বহন করেই চলছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্নহলে ও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েকবার আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের
চেষ্টা চালিয়েছিল কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।কারণ রোহিঙ্গারা আশঙ্কা করেছেন যে, তাদের মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হতে হবে। আর সে কারণেতারা
দেশে ফিরতে রাজিহয়নি। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মতে, রাখাইন রাজ্যেও পরিস্থিতি এখনো রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় নিরাপদে এবং মর্যাদাপূর্ণ ভাবে
ফিরে যাওয়ার উপযোগীহয়নি। তবে বাংলাদেশী সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন যে, তাঁরা এখনো হাল ছাড়ছেননা এবং আশা করছেন রোহিঙ্গাদের রাজি করানো সম্ভব হবে। কূটনীতি বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে বাংলাদেশ মিয়ানমার দি¦-পাক্ষিকসমঝোতা
চুক্তির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় , নিরাপদ এবংমর্যাদাপূর্ণ ভাবেপ্রত্যাবাসন সম্ভব হবেনা। এক্ষেত্রেজাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করতেহবে।
বিশেষকরেচীনএবংভারতকেআস্তায়নিয়েবহুপাক্ষিকসমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। কারণ অর্থনৈতিক ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত নিরাপত্তা সহ আরো নানা ইস্যুতে মিয়ানমার ও চীনএবংভারত একে অপরের উপর
অনেকনির্ভরশীল। বিশেষ কওে চীনের সমর্থনছাড়া মিয়ানমারের আনুকূল্য পাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার। চীনকে আস্তায় এনে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং জাতিসংঘ উন্নয়নসংস্থা (ইউএনডিপি) র সহাযোগীতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরিতহলেই কেবল রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন সম্ভব বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী পশ্চিম মায়ানমারের আরকান রাজ্যে (বর্তমানে রাখাইন রাজ্য) প্রাক-উপনেবেশিক ও উপনেবেশিক আমল থেকে বসবাস করে আসছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তাদের উপর নির্যাতন শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আইন প্রণেতা হিসাবে মায়ানমারের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য মতে ১৯৮২ সালের মায়ানমার নাগরিত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকর ভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তাছাড়া তাদেরকে আন্দোলনের স্বধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ও সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শতাব্দী কাল থেকে বসবাসকারি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নাগরিক পরিচয় বিক্ষুপ্ত করে দমন- পীড়নের মাধ্যমে জাতগত নিধনের প্রচেষ্ঠা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

২০১৭ সালের ২৫ শে আগষ্ট রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি সেনা চৌকিতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কতৃক হামলার অজুহাতে মিয়ানমারের সেনা বাহিনী কতৃক পরিকল্পিত ভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর হামলা শুরু করে। গ্রামের পর গ্রাম জালিয়ে দেয়, হত্যা- ধর্ষণসহ দমন- পীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যার কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে সাত লাখ লোক বাংলাদেশে পালিয়ে এসে শরণার্থী- শিবিরে
আশ্রয় গ্রহণ করে।

এদিকে রোহিঙ্গা শরর্ণার্থীদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্য ২০১৭ সালে বাংলাদেশ মিয়ানমার সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তা কার্যকর হয়নি। বার বার চেষ্টার পর ও ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ ও কার্যকর প্রত্যাবাসনের লক্ষে ২০১৮ সালে জাতি সংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউএনডিপি)জাতি সংঘ শরনার্থী সংস্থার (ইউএন এইচসিআর) সাথে ত্রিপক্ষীয় একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্ত কোন চুক্তিই এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরনার্থীদের কার্যকর প্রত্যাবাসনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি।

বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতি সংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন এবং রাখাইন রাজ্যে বেসামরিক নিরাপত্তা বলয় প্রতিষ্ঠা সহ যে পাঁচ দফা প্রস্তাবনা পেশ করেছেন তা বাস্তাবায়নে কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে । জাতি সংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উক্ত প্রস্তাব পাশ করানোর জন্য জোরদার লবিং করতে হবে। এক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার মত ভেটো ক্ষমতা সম্পন্ন দেশ দুটিকে আস্থায় এনে ভেটো প্রয়োগ থেকে বিরত রাখতে হবে। এভাবে জাতি সংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা ও চাপ অব্যাহত রাখা গেলেই কেবল রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন সম্ভব।

এদিকে রেহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েক জন নেতার সাথে আলোচনা করে জানা যায় যে, তারা দ্রুত নিজ ভূমিতে ফেরত যেতে চায়। তবে তা হতে হবে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই। তাদের বক্তব্য হচ্ছে ১৯৮২ সালে প্রণীত আইন বাতিল করতে হবে। তাদেরকে জাতিগত স্বীকৃতি দিতে হবে।

মত প্রকাশের স্বধীনতা ও চলাফেররা স্বধীনতা দিতে হবে। ধর্মীয় স্বধীনতা, মৌলিক ও মানবাধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। প্রত্যেকের স্ব- স্ব ভিটে- বাড়ি জায়গা- জমি হস্তান্তর করতে হবে। বাংলাদেশ শিবির থেকে মিয়ানমার শিবিরে যেতে তারা মোটেও প্রস্তত নহে। কাজেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আস্তায় নিয়ে আন্তর্জাতিক সমপ্রাদায়কে সম্পৃক্ত করে রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা গেলেই বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক সফলতা বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।

চলবে…

মোজাম্মেল হক

প্রভাষক রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ
টেকনাফ সরকারী কলেজ।
মোবাইল নম্বর:01813142287


শেয়ার করুন