আজ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৫৮ শতাংশই বাংলাদেশে জন্মগ্রহনকারী!

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম হার ২.৬০শতাংশ

বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কয়েকটি রোহিঙ্গা শিশু

বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কয়েকটি রোহিঙ্গা শিশু

জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, টেকনাফ থকে:
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭ শতাংশ হলেও কক্সবাজারের দুটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তা বাড়ছে ২.৬০ শতাংশ হারে। এ ছাড়া অনিব›িদ্ধত রোহিঙ্গা বস্তিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কোন তথ্য উপাত্তই সংশ্লিষ্টদের অজানা । ক্যাম্পে অবস্থানরতদের মধ্যে শুধুমাত্র ৫৮ শতাংশই ক্যাম্পে জন্ম গ্রহনকারী। এখানে অপরিকল্পিত এবং মাত্রাতিরিক্ত জন্মহার এই এলাকায় জনসংখ্যা বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গাদের অতিরিক্ত চাপের কারণে ভেস্তে যেতে বসেছে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম। রোহিঙ্গাদের প্রতিটি পরিবারে অধিক সন্তান নেয়ার পেছনে সন্তানকে সম্পদ মনে করা, শক্তি অর্জন, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার, সরকারি রেশনপ্রাপ্তি এখনো কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দুটি শরণার্থী শিবিরে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম রয়েছে। তবে তা তেমনটি আমলে নেয় না কেউই। আর আন-রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে পরিবার পরিকল্পনার কার্যক্রমই নেই। ফলে রোহিঙ্গাদের কারণে এ অঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট দপ্তর, কিছু বেসরকারী সংস্থা পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও অন্যান্য সরকারী বেসরকারী সংস্থা গুলোকে এগিয়ে আসলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ অনেকটা কমানো যেত এমনটি মনে করেন কেউ কেউ।
এদিকে “ কিশোরীদের জন্য বিনিয়োগ,আগামী প্রজন্মের সুরক্ষা” শ্লোগানে ১১ জুলাই সারা বিশ্বে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০১৬ পালিত হচ্ছে।
মোঃ হোসেন। টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের ছোট দুটি কক্ষে যার বসবাস। একটি কক্ষে ছোট পরিসরের দোকান। অপর কক্ষে স্ত্রী এবং ১১ সন্তান নিয়ে থাকা খাওয়া চলে। তিনি জানালেন, পরিবারের সঙ্গে ১৯৯২ সালে মিয়ানমার থেকে এখানে আসেন। এরপর বিয়ে করেন ক্যাম্পে। সবার রেশন পাওয়ার পরও ছেলে মেয়েকে নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তিনি।
টেকনাফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প এবং পাশে থাকা আন-রেজিস্টার্ড ক্যাম্প ঘুরে জানা গেছে, এখানে যার কম সন্তান তারও কমপক্ষে ৪/৫টি ছেলেমেয়ে রয়েছে। এমনকি ১৫ থেকে ২১ জন সন্তান আছে এমন শরণার্থীর সংখ্যাও কম নয়।
টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের মোহাম্মদ লাল মিয়া বলেন, সাত মেয়ে নিয়ে কষ্টের সংসার চলছে। তিনি বলেন, সন্তান জন্ম হয় আল্লাহর হুকুমে। এটা বন্ধ করা গুনাহের কাজ।
আন-রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের সেক্রেটারী আমির হোসেন বলেন, বিয়ে-শাদী করলে সন্তান অবশ্যই হবে। আমরা ওষুধ ব্যবহার করি না।
আশির দশকে এদেশে রোহিঙ্গাদের ব্যাপকভাবে আগমন শুরু হয়। এরপর থেকে দফায় দফায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। এই রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৫ সালে ৩০ জুনের তথ্য মতে কুতুপালং ক্যাম্পের ২৫৬১ পরিবারে ১৩০৪৫ জন ও নয়াপাড়া ক্যাম্পের ৩৬৭৮ পরিবারের ১৮৭১৪ জনসহ ক্যাম্প দুটিতে ৬২৩৯ পরিবারে ১৩২৯ জন নিকটতম আত্মীয়সহ মোট ৩১,৭৫৯ জন শরণার্থী অবস্থান করছে । এসব পরিবারে গড় সদস্য সংখ্যা হচ্ছে ৭ জন।
তবে এ দুটি ক্যাম্পের সঙ্গে লাগোয়া দুটি আন-রেজিস্টার্ড ক্যাম্প এবং টেকনাফের শামলাপুরে রয়েছে লক্ষাধিক আন-রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা। সেই সঙ্গে উখিয়া টেকনাফে ছড়িয়ে ছিঠিয়ে আছে আরো আড়াই লাখ রোহিঙ্গা। যারা দেশের উপর একটি বাড়তি চাপ।
টেকনাফ ও কুতুপালং ক্যাম্পে বেসরকারিভাবে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেন আরটিএম ইন্টারন্যাশনাল। এ সংস্থার কর্মকর্তা নাসরিন আকতার মনিকা। তার ভাষায়, ‘এরা আসলে লেখাপড়া জানে না। আর আসছে একটা ভিন্ন জায়গা থেকে। ওপার থেকে ২-৩ সন্তান নিয়ে এপারে আসে। এরপর এখানে এসে আরো কয়েকটা সন্তান নেয়। অনেকটা ভাসমান জায়গায় শক্তি ও সম্পদ মনে করে সন্তান জ¤œ দিয়ে থাকে এরা,কী আর করার, এদের মাঝে সচেতনতার বড়ই অভাব।’ তিনি আরো জানান ক্যাম্পে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম পুরচালনা কাজ খুবই কষ্টস্ধ্য একটি কাজ। এরা এতোই কুসংস্খারাচ্ছন্ন যে, সন্তান দেবে আল্লাহ, খাওন পরনও করাবে আল্লাহ এমন বিশ্বাস কিভাবে ভাংঙ্গা যায় বলুনতো। এখানে জন্ম হার ২.৬০ শতাংশ বলে জানিয়েছেন।
দুটি শরণার্থী শিবিরে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম চালালেও আন-রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে এর কোনো বালাই নেই। সে সঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেবের বাইরে। ফলে এ বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে ভেস্তে যেতে বসেছে সরকারের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম।
কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক আমির হোসেন জানান, উখিয়া উপজেলায় সক্ষম দম্পতির সংখ্যা হচ্ছে ৩৬ হাজার ৬১২ জন। এর মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহীতা হচ্ছে ২৭ হাজার ৬৮২ জন এবং এখানে গ্রহীতার হার ৭৫.৬১ শতাংশ।
টেকনাফ উপজেলায় সক্ষম দম্পতির সংখ্যা হচ্ছে ৪৬ হাজার ৬৩৪ জন। এর মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহীতা হচ্ছে ৩৪ হাজার ৯৩৮ জন এবং এখানে গ্রহীতার হার ৭৪.৯২ শতাংশ। আর পুরো জেলায় সর্ব মোট সক্ষম দম্পতি ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৮০১ জন। পদ্ধতি গ্রহণ করেছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৯৬৯ জন। সব মিলিয়ে পদ্ধতি গ্রহণের হার ৭৫.৪১ শতাংশ।
টেকনাফ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শ্রুতিপূর্ণ চাকমা জানান, টেকনাফে ৩২ জন পরিবার কল্যান সহকারীর (এফডাব্লিউএ) জায়গায় ক বছর ধরে ১৭ জন নিয়ে গোটা উপজেলায় কাজ করতে হচ্ছে। ১৫ জন মাঠকর্মীর অভাব এখনো পূরন করা যাচ্ছে না। এখানে স্থানীয়রা কাজ করতে চায় না। ইতিমধ্যে উপক’লীয় বাহারছড়া ইউনিয়নে মাঠকর্মী শূণ্য রয়েছে। দু জন মাঠকর্মী শিক্ষকতা পেশায় চলে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানান তিনি। খোজঁ নিয়ে জানা যায়, অন্যান্য উপজেলাতে শূন্য পদ পূরনে “পেইড পিয়ার ভোলান্টিয়ার” নিয়োগের ভিত্তিতে মাঠকর্মী নিয়োগ দিয়ে কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হলেও টেকনাফে তা করা হয়নি। বর্তমানে প্রতিজন কর্মীকে কয়েক হাজার সক্ষম দম্পতিকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।
উখিয়া টেকনাফ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় এখানে পরিবার পরিকল্পনা র্কাযক্রম জোরদার করা দরকার বলে মনে করেন সচেতন মহল।
এদিকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মাঝে সন্তান বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে ধর্মীয় কুসংস্কার অন্যতম। এছাড়া অজ্ঞতাও এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে না পারলে দেশের মূল জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে যেমন এর প্রভাব পড়বে। তেমনি যথাসময়ে সরকারের এমডিজি অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাও থেকেই যাচ্ছে। তাই রোহিঙ্গাদের মাঝে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের আগ্রহ সৃষ্টির জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
রোহিঙ্গারা সন্তান বেশি নেওয়ার কারণ হিসেবে স্থানীয় রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মুজাম্মেল হক বলেন, রোহিঙ্গারা বেশীর ভাগ সময় স্বামী-স্ত্রী সংস্পর্শে থাকে। এদের অজ্ঞতা হলো যত বেশি সন্তান প্রসব করবে তত বেশি রেশন সামগ্রী পাওয়া যাবে। আর এ চিন্তা থেকেই তাদের মধ্যে ঘন ঘন সন্তান প্রসব হয়।এছাড়া কাজকর্ম করে অভাবের সংসারে কিছুটা সহযোগি হবে এমন ধারনা থেকেও সন্তান বেশী নেন রোহিঙ্গারা।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯১-৯২ সালে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের কারণে মায়ানমার হতে প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় গ্রহন করে। বাংলাদেশ সরকার মায়ানমারের উদ্বাস্তুদেরকে মানবিক কারণে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ দেয় এবং তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে। বাংলাদেশ সরকার শরণার্থীদের জন্য বাসস্থান, ঔষধ, খাদ্য এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করে। ১৯৯২ সালে গণনা পূর্বক ২,৫০,৮৭৭ জন শরণার্থীকে রেজিষ্ট্রেশন করা হয়। উক্ত শরণার্থীদেরকে ২০টি ক্যাম্পে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে ২৮শে জুলাই ২০০৫ খ্রি: পর্যন্ত সময়ে মোট ২,৩৬,৫৯৯ জন শরণার্থীকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন এবং ২০০৬ থেকে ২০০৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৯২৬ জন শরণার্থীকে অন্য দেশে স্থানান্তর করা হয়।


শেয়ার করুন