রোহিঙ্গা ইস্যু: সংকট উত্তরণে সহায়ক হবে

মোহসীন-উল হাকিমঃ

টেকনাফ। কক্সবাজারের একটি উপজেলা। দেশের সব গণমাধ্যম এই অঞ্চলকে একটি উপজেলা হিসেবেই দেখে আসছে বছরের পর বছর। অথচ এই উপজেলা ভূরাজনৈতিক দিক থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ। একই কারণে গুরুত্বপূর্ণ বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম, লামা কিংবা থানচি।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে এই অঞ্চলগুলো অস্থির লম্বা সময় ধরেই। সরকারের সংশ্লিষ্টদের এ নিয়ে শুরু থেকে মাথা ব্যথা ছিল কি না তা নিয়ে আমার প্রশ্ন রয়েছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোও এ বিষয়ে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমি নিজেও এদিক থেকে একজন ব্যর্থ সাংবাদিক। কারণ রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আমি নিজেও অনুসন্ধানী তেমন কোনো প্রতিবেদন করিনি, করতে পারিনি।

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের নিয়ে সংকটটি বাড়তে বাড়তে এখন চরম আকার ধারণ করেছে। চরম বলতে শুধু এগারো লাখ মানুষের চাপ নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংকট হিসেবে এটি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। ভূরাজনৈতিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার দৃষ্টিতে এই সংকট বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট, সন্দেহ নেই।

২০১২ সালের জুন-জুলাই মাসের কথা মনে পড়ছে। সে বছর অপপ্রচার চালিয়ে রাখাইনদের গ্রামে আগুন জ্বালানো হয়েছিল। রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে দফায় প্রবেশের সুযোগ দেয়নি বাংলাদেশ। প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ফিরে গিয়েছিল যার যার ঘরে।

আনুষ্ঠানিকভাবে আসার সুযোগ না পেলেও এরপর সীমান্ত পেরিয়ে তারা ঢুকে পড়েছিল বাংলাদেশে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছি আমরাই। স্থানীয় কেউ কেউ তাদের নিয়ে আসা, আশ্রয় দেওয়ার কাজটি করেছেন। দুই-তিনটি আন্তর্জাতিক এনজিও তখন রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা দেওয়া ও ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে আসার সুযোগ না পেলেও এরপর সীমান্ত পেরিয়ে তারা ঢুকে পড়েছিল বাংলাদেশে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছি আমরাই।
২০১২ সালের সেই ঢেউয়ের পর তিনটি এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। এভাবেই আরও কয়েকটি বছর কেটে যায়। তারপর আসে ২০১৭ সালের আগস্টের ইনফ্লাক্স (কোনো স্থানে লোকজনের ক্রমাগত আগমন)।

১৯৭৮, ১৯৯১-৯২, ২০১২, ২০১৫, ২০১৬ ও সর্বশেষ ২০১৭ সালে দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে। হিসাব অনুযায়ী, মোট এগারো লাখ মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশের কয়েকটি শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছে। আর্থসামাজিক ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে যা বাংলাদেশের উপর বিশাল একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে। চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে ইয়াবা পাচার কিংবা সশস্ত্র হয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা, হত্যা, অপহরণ আর মুক্তিপণ আদায় করার ঘটনা ঘটছে অহরহ।

চাঁদাবাজি ক্যাম্পের ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশের লোকালয়েও। অভিযোগের তীর রোহিঙ্গাদের একটি মাত্র সশস্ত্র সংগঠন আরসার দিকে। অথচ কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল এই আরসা বা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি। সংগঠনটির আন্তর্জাতিক নাম আল ইয়াকিন। যার নেতৃত্বে আছেন আতাউল্লাহ। পাকিস্তানে জন্ম, বেড়ে ওঠা এই আতাউল্লাহ এখন কোথায় আছেন? কী করছেন? তার সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের কোনো সম্পর্ক আছে কি না? এসব নিয়ে আমাদের কোনো গোয়েন্দা তথ্য কি আছে? এসব নিয়ে আসলে আমরা কতোটুকু জানি?

যদি রোহিঙ্গাদের মুক্তিই তাদের উদ্দেশ্য হয় তবে ক্যাম্পগুলো ও সীমান্ত জুড়ে ত্রাস ছড়ানোর কথা ছিল কি? অথচ কক্সবাজার ও নাইক্ষ্যংছড়ির লোকালয় থেকে বাংলাদেশি নাগরিক অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় আর হত্যার মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে এই সংগঠনের সদস্যরা। আগেও বলেছি মরণ নেশা ইয়াবা বাণিজ্যে আরসার সম্পৃক্ততা আজ প্রতিষ্ঠিত।

আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে। চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে ইয়াবা পাচার কিংবা সশস্ত্র হয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা, হত্যা, অপহরণ আর মুক্তিপণ আদায় করার ঘটনা ঘটছে অহরহ।
পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া, সৌদি আরবে বেড়ে ওঠা কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নেতৃত্বে শরণার্থীদের সংগঠন কীভাবে এ পর্যন্ত এলো? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দীর্ঘ অনুসন্ধান প্রয়োজন।

গত এক বছর ধরে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করছে সরকার। পুরো সমস্যা বিবেচনায় বিষয়টি খুব বড় কোনো ইস্যু নয়। এই স্থানান্তর নিয়ে অনেক শক্তি খরচ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোকে ভাসানচরে আনতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে সরকারের। ভাসানচর নিয়ে আমরা সাংবাদিকরাও অনেক কাজ করেছি। তবে সেই কাজের প্রতিফলন মূল সমস্যা সমাধানে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এদিকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ঘনীভূত জটিল পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থানের পর। যার ছোঁয়া পড়েছে সীমান্তে। কখনো কখনো সার্বভৌমত্ব নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে। অন্যদিকে এই অঞ্চলটি নিয়ে বিশ্ববাসীর আগ্রহও অনেক। সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা এখন আদা জল খেয়ে কাজে নেমেছেন।

যতটুকু খবর পাচ্ছি, অনেক দিক থেকে কাজের অগ্রগতিও বেশ। তবে এখনো আমরা গণমাধ্যম কিছু নির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া এই সংকট নিয়ে গভীর কোনো কাজ করতে পারিনি। এ বিষয়ে কাজ করতে গেলে বিস্তর গবেষণা করতে হবে, মাঠে পড়ে থাকতে হবে মাসের পর মাস, লাগবে টিমওয়ার্ক। কিন্তু নিউজ রুমগুলো এখনো সেদিকে নজর দিচ্ছে বলে মনে হয় না।

বলতে চাই, বিশাল সংকটটি সামনে আরও বড় আকার ধারণ করবে। হয়তো উগ্রবাদ কিংবা জঙ্গিবাদেরও উত্থান ঘটবে এখানে। তার আলামতও রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশি-বিদেশি মদদে জঙ্গিবাদ ছড়ানোর উদ্যোগ ধরাও পড়েছে। এগুলো সমাধানের দায়িত্ব যাদের ঘাড়ে তারা সেটি করবেন।

পেছনে থেকে এসবের খবর সংগ্রহ ও প্রচার বা প্রকাশ সাংবাদিকদের দায়িত্ব, আমাদের দায়িত্ব। তাই মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা জনপদগুলোকে জেলা বা উপজেলা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। দেরি হয়েছে অনেক। এবার সংবাদ কক্ষগুলোর সেরা সাংবাদিকদের নামতে হবে কাজে।

আমাদের প্রিয় ভূখণ্ড বাংলাদেশ। দেশের স্বার্থে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। না হয়, বড় সংকট মোকাবিলা অসম্ভব।

মোহসীন-উল হাকিম ।। সাংবাদিক

সূত্রঃ ঢাকা পোস্ট


শেয়ার করুন