রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

 

সিটিএন ডেস্ক :

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংকট মোকাবিলায় ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুসলিম বিশ্বের মানুষদের কেন উদ্বাস্তু হয়ে দেশে দেশে ঘুরতে হবে তার কারণ অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করবার প্রতি মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি । তিনি বলেছেন, সংকট সমাধানে আপনাদের ঐক্য প্রদর্শন করুন।
মঙ্গলবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ওআইসি কনট্যাক্ট গ্রুপের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। ওআইসির মহাসচিব ইউসেফ আল উথাইমিন বৈঠকে সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত ওই ২৭ দফা ঘোষনা গৃহীত হয়। পাশাপাশি চলমান সহিংস ঘটনার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় ্ওই বৈঠক থেকে।
বৈঠকে শুরুতে মিয়ানমারের সর্বশেষ পরিস্থিতির উপর একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেণ মহাসচিব। এরপরপরই বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় তিনি মিয়ানমারে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ঢল সামলাতে বাংলাদেশের জন্য ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশগুলোর কাছ থেকে ‘জরুরি মানবিক সহায়তা’র আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সামরিক অভিযানে মুসলিম ভাই ও বোনেরা জাতিগত নির্মূলের মুখোমুখী হওয়ায় রোহিঙ্গাদের সর্বকালের সবচেয়ে বৃহত্তম দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেছে।
প্রধানমন্ত্রী ওআইসি নেতাদের অবহিত করেন যে, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে স্থল ও নদী পথে সীমান্ত অতিক্রম করে ৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে, এদের ৬০ শতাংশই শিশু।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি একটি অসহনীয় মানবিক বিপর্যয়। আমি নিজে তাদের অবস্থা পরিদর্শন করেছি এবং আমি তাদের বিশেষ করে নারী ও শিশুর ভয়ঙ্কর দুঃখ-দুর্দশার ঘটনার বর্ণনা শুনেছি। আমি আপনাদের সবাইকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এবং এখানে এসে মিয়ানমারের বর্বরতার ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে শুনুন। এসময় প্রধানন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ৬টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব মুসলিম বিশ্বের নেতাদের সামনে তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, মিয়ানমার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে প্রচারণা চালাচ্ছে, অবশ্যই তা বন্ধ করতে হবে এবং দেশটিকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে।
তবে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর আগ পর্যন্ত ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশগুলো থেকে বাংলাদেশকে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ সময় বলেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সকল ধরনের নির্মমতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদেরকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে অবশ্যই তাদের স্বদেশে ফেরত নিতে হবে।
তিনি নিরপরাধ নাগরিক বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের সুরক্ষা দিতে মিয়ানমারের ভেতরে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরির প্রস্তাব দেন এবং ‘অনতিবিলম্বে নিঃশর্তভাবে এবং সম্পূর্ণভাবে ’ কফি আনান কমিমনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সর্বশেষ উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে প্রবেশের আগে থেকেই গত তিনদশকে বাংলাদেশ তাদের আরো ৪ লাখ উদ্বাস্তু আশ্রয় দিয়েছে।
তিনি বলেন, স্থান ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা সব মিলে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছি। বাংলাদেশ দুর্দশাপীড়িত এই লোকদের খাদ্য, আশ্রয় এবং জরুরি সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী- রোহিঙ্গারা ‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী’ মিয়ানমারের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, সমস্ত ঐতিহাসিক দলিল প্রমাণ করে যে রোহিঙ্গারা কয়েক শতাব্দী ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে।
শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমার পরিকল্পনা মাফিক সংগঠিত ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের তাদের পৈতৃক নিবাস থেকে জোরপূর্বক বহিষ্কার করছে এবং নিকট অতীতে তারা দেশের স্বীকৃত সংখ্যালঘু গ্রুপের তালিকা থেকে প্রথম রোহিঙ্গাদের বাদ দেয়।
তিনি বলেন, ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয় এবং পরে তাদের নিজ দেশে ইন্টারনালি ডিসপ্লেস পার্সন’স (আইডিপি) ক্যাম্পে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার সকল রোহিঙ্গাকে তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘তবে মিয়ানমার সরকার এ আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না, বরং রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো বন্ধ করতে সীমান্তে স্থলমাইন পেতে যাচ্ছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ‘জাতিগত নিধনের’ অবসান দেখতে চায়। ‘মুসলিম ভাই- বোনদের দুর্দশার অবসান হওয়া দরকার। এই সংকটের মূলে মিয়ানমার এবং মিয়ানমারেই এর সমাধান পাওয়া যাবে।
এদিকে ওআইসির ওই বৈঠকে ২৭ দফা ঘোষনা গৃহীত হয়েছে বলে নয়াদিগন্তকে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পরারাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে- মিয়ানমার সরকারকে অবিলম্বে রাখাইন প্রদেশে কত মানুষ নিহত হয়েছেন, কত বাড়িঘর জ্বালানো হয়েছে, কত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তা নিরুপন করে একটি অফিসিয়াল বিবৃতি দিতে হবে।
জতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল এর ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনকে এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করবার ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার সুযোগ নিতে মিয়ানমার সরকারকে সহায়তা করতে হবে। সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমার সরকারকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে। ১৯৮২ সালে প্রণীত বিতর্কিত নাগরিক আইন বাতিল করতে হবে।
এছাড়াও জাতিসংঘের প্রতিও বেশ কয়েকটি দাবী আসে ওই ঘোষনা পত্রে, রাখাইন প্রদেশে হত্যাজজ্ঞ বন্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। চলমান অধিবেশনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের রক্ষায় প্রস্তাব পাশ করতে হবে।
উল্লেখ্য মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে গত ২৫ আগস্ট সেনা-পুলিশের ৩০টি চৌকিতে হামলার পর দমন-পীড়ন শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। এরপর প্রাণভয়ে স্রোতের মতো বাংলাদেশে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। এরইমধ্যে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গার সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়েছে। তাদের মধ্যে ২ লাখ ৪০ হাজার শিশু বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবিক সহযোগিতাকারী সংগঠনগুলোর জোট ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)।


শেয়ার করুন