রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরার অপেক্ষায়

pic-ukhiyacox20062017-794x540-794x540শফিক আজাদ, উখিয়া:

পাশ^বর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার সুযোগ সৃষ্টির অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন রোহিঙ্গারা। অথচ রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টি দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও সমাধান হয়নি। এতে কক্সবাজারের অনিয়ন্ত্রিত রোহিঙ্গা বসবাসের ফলে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। তবে রোহিঙ্গারাও চায়, সম্মানজনকভাবে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর দাবি সংশ্লিদের। ২০জুন আন্তর্জাতিক শরনার্থী দিবস উপলক্ষ্যে গতকাল মঙ্গলবার উখিয়ার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা এবং স্থানীয়দের নিয়ে দিবস পালন করেছে।

উখিয়ায় কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় অবস্থিত দু’টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিবন্ধিত শরণার্থীর সংখ্যা ৩২ হাজার। এর বাইরেও কুতুপালং ও বালুখালীতে অনিবন্ধিত লক্ষাধিক ছাড়াও প্রায় ৫ লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে বলে ধারণা করা হলেও কোন সংস্থার কাছেই নেই এর সঠিক পরিসংখ্যান। পাশাপাশি, মিয়ানমারে সহিংসতাসহ নানা কারণে প্রতিবছরই বাড়ছে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ শরণার্থীর সংখ্যা।

রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন তরান্বিত করার দাবীতে উখিয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক কুতুপালং শরনার্থী ক্যাম্প সংলগ্ন রাস্তায় এক মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে উপস্থিত ছিলেন, উখিয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী, সদস্য মুজিবুল হক আজাদ, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, এম.এ মনজুর, সাংবাদিক রতন কান্তি দে, নুরুল হক খান, ইলিয়াছ কাঞ্চন, মৌলভী বখতিয়ার আহাম্মদ, আবুল হোছন মাঝি, ডা: মুজিব, মাহমুদ উল্লাহ মেম্বার প্রমুখ। এসময় বক্তারা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা আজ জাতীয় সমস্যা পরিনত হয়েছে। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারকে সমাধান করতে হবে। যেহেতু যুগযুগ ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। তারা ঐদেশেরই নাগরিক। সম্প্রতি মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে সেনা ও রাখাইন উগ্রাবাদিরে হাতে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা সীমান্ত অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে।

সুত্রে জানা গেছে, বিগত ১৯৮০ দশকে ১ম দফায় এদেশের রোহিঙ্গাদের আগমন ঘঠে। নাইক্ষ্যংছড়ি, রামু, উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত অতিক্রম করে এসময় প্রায় ২লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে সরকারের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে দু’দেশের সফল কুটনীতিক তৎপরাতায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। অতি অল্প সময়ে প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যেতে সক্ষম হলেও বাদ বাকী রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের বিভিন্ন বন জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করে।

দ্বিতীয় দফায় ১৯৯১ সালে সীমান্তের নাফ নদী অতিক্রম করে প্রায় ২লক্ষ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ, রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন শরাণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমার সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে বৈঠক করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চুড়ান্ত করে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ২ লক্ষ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে ফেরৎ পাঠানো হলেও টেকনাফের নয়া পাড়া শরণার্থী শিবিরে ১ হাজার ৭৭৫ পরিবারের ১৪ হাজার ৪৩১জন রোহিঙ্গা এবং উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের ১ হাজার ১৯৪ পরিবারে ৯ হাজার ৮৫০ জন সহ প্রায় ২৮ হাজার রোহিঙ্গা দুই ক্যাম্পে অবস্থান করে। ২০০৪ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। যা এখনো পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। পাশাপাশি ২০১৬সালের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সেনা ও রাখাইন উগ্রবাদিদের হাতে নানান নির্যাতনের শিকার হয়ে নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে প্রায় আরো ৯৫হাজার রোহিঙ্গা। এছাড়াও বিভিন্ন সময় অনুপ্রবেশকারী মিলে প্রায় ৫লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ অবস্থান করছে বলে নানান সুত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

উখিয়ার কুতুপালং এলাকার ইউপি সদস্য বখতিয়ার আহমদ বলেন জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কিছু সংগঠন তাদের নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তাদের সুযোগ-সুবিধার কারণে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করছে। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়াতেই আটকে আছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন। দীর্ঘ সময় ধরে নানা কারণে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরার বিষয়টি ঝুলে আছে।

সম্মানজনক প্রত্যাবাসন হলে নিজ দেশে ফিরে যেতে চান তারা। বালুখালী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের সি ব্লকের মাঝি লালু মিয়া, এফ ব্লকের মাঝি ছাবের আহমেদ বলেন আমরা বাংলাদেশি না। মিয়ানমার আমাদের জন্মস্থান, আমরা মিয়ানমারেরই নাগরিক। মাত্র ৬মাস পুর্বে বাংলাদেশে এসেছি এখন নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মোঃ আলম, আব্দু শুক্কুর বলেন, মিয়ানমারে যেমন বৌদ্ধরা নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস করছে, ঠিক তেমনি আমরাও মিয়ানমারে নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস করতে চাই। কারণ আমরাও মিয়ানমারের নাগরিক। সরকার আমাদেরকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাক এটাই আমাদের একমাত্র দাবি। এদিকে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ্য করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো দরকার। তা নাহলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান কোন দিনও হবে না। সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।


শেয়ার করুন