পর্তুগাল ১- ফ্রান্স ০

রূপকথার রাতে ইতিহাসের পাতায় রোনালদোর পর্তুগাল

607136815_mh_3157_d8844c1671e01bef5856fa6b161b6f9f_3545_119520রোনালদো দুইবার কাঁদলেন। একবার ২৪তম মিনিটে। মাঠ ছাড়ার সময়। আরেকবার এডার গোল করার পর। দুই কান্নায় বিস্তর তফাৎ! পুরো ম্যাচ না খেলেও তিনি আজ চ্যাম্পিয়ন। মেসি যা পারেননি, পর্তুগালের হয়ে তিনি তাই পারলেন। দেশকে এনে দিলেন প্রথম বড় শিরোপা। এমন রাতে কেউ না কেঁদে পারে?

রোনালদোহীন পর্তুগাল আজ মন ভরানো ফুটবল না খেললেও গ্রিজম্যানদের সেভাবে আক্রমণ গড়তে দেননি ফন্টে, কারভালহো, পেপেরা। পর্তুগালের একাদশে ফিরে আসেন পেপে। অন্যদিকে জার্মানির বিপক্ষে ফ্রান্স যে একাদশ নিয়ে মাঠে নেমেছিল আজও ছিল সেই একাদশ। ম্যাচের প্রথম কয়েক মিনিট দুই দলই এলোমেলো ফুটবল খেলতে থাকে। গ্রিজম্যান একটা সুযোগ পেয়েছিলেন চতুর্থ মিনিটের মাথায়। কিন্তু কাজে লাগাতে পারেননি।

১০ম মিনিটে ফের তার হেড ফিরিয়ে দেন ওই পর্তুগালের গোলরক্ষক। দারুণ মাথা দিয়েছিলেন। কোনোমতে গোলমুখি বল ফেরাতে সক্ষম হন প্যাট্রিসিও।

ফ্রান্স প্রথমার্ধের শুরুতে ৪-৪-২ এ আক্রমণে যায়। জিরৌদের সঙ্গে মূল ফরওয়ার্ড হিসেবে খেলতে থাকেন গ্রিজম্যান। অন্যদিকে পায়েট অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে নেমে যান। এভরা ডিফেন্সে রোনালদোকে নড়তে দেননি। সঙ্গে কভার করেছেন পায়েট। অষ্টম মিনিটে রোনালদোর কাছ থেকে এই দুজনের বল নেয়া দেখলেই ফ্রান্স কোচের কৌশলের ছবি স্পষ্ট হয়। রোনালদো বল ধরতেই এভরা চার্জ করেন। পেছনে ছিলেন পায়েট। তিনি বল ক্লিয়ার করেন। রোনালদোকে বেশ জোরে ট্যাকল করেন এভরা। ১৮তম মিনিটে ওই এভরাই আবার রোনালদোকে কড়া চার্জ করেন। অর্থাৎ শুরু থেকেই সিআরসেভেনকে ভড়কে দেয়ার চেষ্টা করেন দেশম’র ছেলেরা। ধাক্কাধাক্কির এই কৌশলে তারা ‘সফল’ হয়। ২৪ মিনিটের সময় মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন পর্তুগীজ অধিনায়ক। তার পরিবর্তে মাঠে নামেন কুয়ারেসমা।

রোনালদো বাইরে যাওয়ার পর খেলায় কিছুটা পরিবর্তন আনে ফ্রান্স। গ্রিজম্যান আবার কিছুটা নিচে নেমে আসেন। জিরৌদ চলে যান সেন্টার ফরওয়ার্ডে। তাতে গ্রিজম্যানের সঙ্গে পগবা আর মাতুইদির যোগাযোগ বাড়ে। ৩৪তম মিনিটে সিসসোকো বক্সের ভেতর থেকে দারুণ শট নিয়েছিলেন গোলে। বল সরাসরি পর্তুগীজ কিপারের বুকে আঘাত হানে। একটু এদিক-ওদিক করতে পারলে ফায়দা লুটতে পারতেন।

পর্তুগীজদের ডিফেন্সে উমিতিতিকে বেশ কার্যকরী মনে হয়। ন্যানিদের একদম যায়গা দেননি। সিসসোকো লেফট উইং থেকে বারবার বল নিয়ে ভেতরে ঢুকছিলেন। কখনো আবার কাট করতে করতে রাইট উইংয়ে চলে আসছিলেন। সিলভা-ন্যানি দুই/তিন বার ফ্রান্সের বক্সে ঢুকে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে পগবা, মাতুইদি মিডফিল্ড থেকে নেমে এসে রক্ষণে ভিড় বাড়ান। এভাবে গোলশূন্য অবস্থায় শেষ হয় প্রথমার্ধ।

দ্বিতীয়ার্ধে পর্তুগালকে বেশ গোছানো মনে হয়। আক্রমণে নজর দেয় দলটি। নিজেদের অঞ্চলে কম বল রেখে উইং প্লেতে শক্তি বাড়ায় ফারনানদো স্যান্তোসের ছেলেরা। ৫৮তম মিনিটে পায়েটকে উঠিয়ে মিডফিল্ডার কোমানকে মাঠে আনেন দেশম। মাঝমাঠের খেলায় আরেকটু ছন্দ আনতে তার এই পরিবর্তন। দ্রুত ফলও পেতে পারতো ফ্রান্স। ওই কোমান লেফট উইং থেকে বল ধরে গ্রিজম্যানের জন্য দারুণ একটি ক্রস পাঠান। কিন্তু স্পট হেডে ‘দুর্বল’ গ্রিজম্যান তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন। দ্বিতীয়ার্ধে ফ্রান্সকে বেশ কয়েকটি দূরপাল্লার শট নিতে দেখা যায়। কিন্তু একটাও কাজে আসেনি।

৭২ মিনিটের সময় জিরৌদ কোমানকে দারুণ একটি পাস দিয়েছিলেন। আগুয়ান কোমান প্রথম টাচটা ঠিকমতো নিতে পারলে ফল আসতে পারতো। বক্সের ভেতর দারুণ পজিশনে ছিলেন। জিরৌদের মাটি কামড়ানো পাসে পা দিতে যাবেন, এমন সময় পর্তুগীজ ডিফেন্ডার চকিতে টোকা দিয়ে বল ক্লিয়ার করেন।

৭৫তম মিনিটে জিরৌদ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কোমানের পাস দেয়া বল তড়িৎ গতিতে ধরে বা পায়ে গোলে শট নেন। এবারও দেয়াল হয়ে দাঁড়ান ওই প্যাট্রিসিও। ৭৮ তম মিনিটে জিরৌদকে উঠিয়ে ফরওয়ার্ড গিগনাক মাঠে নামান দেশম। ফ্রান্সের গোলরক্ষক বেশিরভাগ সময় একা থাকলেও চূড়ান্ত পরীক্ষা দেন ৭৯তম মিনিটে। সতীর্থ ডিফেন্ডারের ভুল পাস তার দিকে আসলে পাঞ্চ করে বের করে দেন। ঠিক পরের মুহূর্তে আরেকটি বল দুর্দান্তভাবে গ্রিপ করে স্বাগতিকদের রক্ষা করেন। ৮৪তম মিনিটে বক্সের বেশ বাইরে থেকে চোখজুড়ানো এক শট নেন ফ্রান্সের সিসসোকো। বা পায়ে রিসিভ করে ডান পায়ে নিয়েছিলেন। শটটি উঁচুতে ওঠেনি। প্যাট্রিসিও তৎপর না থাকলে নির্ঘাত বিপদে পড়ত পর্তুগাল। বা দিকে ডাইভ দিয়ে সেভ করেন।

সিসসোকো অনেক নিচে থেকে বল ধরে বারবার আক্রমণে আসছিলেন। কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছিল তাকে। পর্তুগালের রক্ষণে ভালো জায়গায় বল প্লেস করতে পারছিলেন না। দ্বিতীয়ার্ধে সময় বাড়ার সাথে সাথে গ্রিজম্যান কেমন যেন ম্যাচ থেকে হারিয়ে যাচ্ছিলেন। আসলে তাকে জায়গা দিচ্ছিলেন না পর্তুগীজ ডিফেন্ডাররা। ৯২তম মিনিটে স্বাগতিকদের বদলি ফরওয়ার্ড গিগনাককে হতাশ করে বার। গোলের বেশ কাছ থেকে শট নিয়েছিলেন। প্যাট্রিসিওকে পরাস্তও করতে সক্ষম হন। কিন্তু বল লাগে প্রথম পোস্টে। রেফারি অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের বাঁশি দেন। গ্রুপ পর্বে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষেও ঠিক এমনিভাবে একবার হতাশ হন গিগনাক।

নির্ধারিত মিনিটের খেলায় ফ্রান্স গোলে মোট শট নেয় ৭টি। পক্ষান্তরে পর্তুগাল মাত্র একটি। বল দখলেও স্বাগতিকরা এগিয়ে ছিল, ৫৪ শতাংশ বনাম ৪৬ শতাংশ। ১০৪ মিনিটের মাথায় ফ্রান্সকে আরেকবার রক্ষা করেন গোলরক্ষক। কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে হেড করেন এডার। কোনোমতে তা ঠেকাতে সমর্থ হন হুগো।

অতিরিক্ত সময়ের শেষ ১৫ মিনিটের শুরুতে বক্সের ঠিক সামনে ফ্রি-কিক পায় পর্তুগীজ। সেবার গোলপোস্টের কল্যাণে ফ্রান্স বেঁচে গেলেও পরের মিনিটে এডারের পা থেকে বাঁচতে পারেনি স্বাগতিকরা। ফ্রান্সের ডিফেন্স তখন এলোমেলো। এডার বক্সের সামনে থেকে বল ধরে ড্রিবল করতে করতে ভেতরে ঢোকেন। হঠাৎ ডান পায়ে মাটি কামড়ানো শট নেন। ডান দিকে অনেকটা ডাইভ দিয়েও বলের নাগাল পেতে ব্যর্থ হন ফ্রান্সের গোলরক্ষক। এডার যখন শট নেন, তখন সামনে ছিলেন স্যামুয়েল উমিতিতি। কী মনে করে যেন বলে যাননি। বরং শট নেয়ার সময় চোখ বন্ধ করে লাফিয়ে ওঠেন! ক্ষণিকের ভুলে গ্রিজম্যানদের স্বপ্ন ধূসর হয়ে যায়। ঠিক যেন জার্মানি-ফ্রান্স ম্যাচের প্রতিচ্ছবি। তুলনামূলক ভালো খেলেও পরাজিতের নাম ফ্রান্স। আর না খেলেও চ্যাম্পিয়ন রোনালদো। ইতিহাস কখনো বলবে না রোনালদো অল্প সময় মাঠে ছিলেন। ইতিহাস বলবে সেই রাতে রোনালদো কতবার কেঁদেছিলেন তার ইয়ত্তা নেই।

আচ্ছা মেসি কি ম্যাচটি দেখেছেন?


শেয়ার করুন