রিজার্ভ তছনছ বিকাশ ও রকেটের আড়ালে হুন্ডিতে

ডেস্ক নিউজঃ

মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বিকাশ ও রকেটের আড়ালে হুন্ডিতে তছনছ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড লাগিয়ে হুন্ডির ব্যবসা করছে বিকাশ ও রকেট। ফলে দেশে আসছে না ডলার। ডলার সংকটে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানায় অচলাবস্থার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বন্ডে বিনিয়োগও মন্দা। প্রবাসীদের বন্ড নবায়ন হচ্ছে না।
অংশীজনরা বলছেন, বন্ডে বিনিয়োগ বাড়াতে প্রচলিত আড়াই শতাংশের সঙ্গে আরও ১ শতাংশ প্রণোদনাসহ তিন স্তরে বিনিয়োগ সুবিধা প্রয়োজন। তবেই কমতে পারে হুন্ডি।

পাশাপাশি হুন্ডিতে জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের অনুসন্ধান ও বিদেশে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো জরুরি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সবার আগে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। একটি গ্রহণযোগ্য মূল্য নির্ধারিত হলেই অনেক কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

তবে মনিটরিং করতে হবে কেউ যেন উন্মুক্ত বাজার দরের সুবিধা নিয়ে অতি মুনাফা না করে। তিনি বলেন, প্রবাসী বন্ড নবায়ন না করলে তো ডলার আবার বিদেশেই চলে যাবে। ডলার সংকটের এই সময়ে প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগের সীমা অবশ্যই তুলে নেওয়া উচিত।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন- এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কনভেনশনাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আগের নিয়মে চললে হবে না।

বন্ডে বিনিয়োগের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে। চলমান পরিস্থিতিতে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। হুন্ডি কমাতে রেমিট্যান্সে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। প্রণোদনা বাড়ালে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়বে। রপ্তানির জন্য ১০ থেকে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে রেমিট্যান্সে মাত্র আড়াই শতাংশ। প্রণোদনা বাড়ানো গেলে হুন্ডি কমবে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশগুলোতে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর এক্সচেঞ্জ হাউসের উদ্যোগে প্রবাসীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করা যেতে পারে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, সৌদি আরব, দুবাই গিয়ে প্রবাসীদের সমস্যাগুলো শুনে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি রেমিট্যান্স পাঠানো সহজ করতে হবে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্যাংকের অংশীজনরা জানিয়েছেন, দেশে প্রবাসীদের টাকা হুন্ডিতে আসছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। এতে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা মার্কিন ডলার বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ, অন্যদিকে সমান্তরালভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বিকাশ ও রকেটের নামে প্রকাশ্যে হুন্ডির ব্যবসা চলছে। এসব বন্ধে বিদেশে কড়া গোয়েন্দা নজরদারি প্রয়োজন। অংশীজনদের মতে, প্রবাসীরা ১ কোটি টাকার বেশি বন্ড কিনতে পারেন না। আবার বন্ড নবায়ন হচ্ছে না। প্রবাসী বন্ডের ক্রয়সীমা বা সিলিং ১ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৫ থেকে ১০ কোটি করা হলে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যেত। এক্ষেত্রে বন্ডে তিন স্তরে বিনিয়োগ সুবিধা প্রয়োজন। আবার আড়াই শতাংশ হারে যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে আরও ১ শতাংশ অতিরিক্ত প্রণোদনা দেওয়া হলে রিজার্ভ বাড়বে। এই ১ শতাংশ প্রণোদনা প্রবাসীরা যখন দেশে ফিরবেন, তখন দেওয়া হলে সরকার ও প্রবাসী উভয়ে লাভবান হবেন।

অংশীজনরা আরও বলছেন, অনেকে পুনর্বিনিয়োগ না করার কারণেও রিজার্ভ কমে গেছে। ডলার বন্ড প্রত্যাহার করতে হবে। রেমিট্যান্স না এলে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি বাড়বে। এদিকে হুন্ডিতে জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার দাবি উঠেছে সব মহলে। গত ৮ নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ মন্তব্য করে বলেছেন, জনগণের টাকা আত্মসাৎ, লুটপাট ও পাচারকারীদের ‘স্যুট ডাউন’ করা উচিত। অর্থ পাচারকারীরা জাতির শত্রু। অর্থ লুটপাট, পাচারের মামলার সামারি ট্রায়াল (দ্রুত বিচার) হওয়া উচিত।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়াটা একটি ফালতু ব্যবস্থা। যখন রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল তখন এটা করতে পারত। ডলার সংকটের এই সময়ে ১ কোটি টাকা প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ খুব বেশি নয়। যত দ্রুত সম্ভব প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ নবায়ন করা উচিত। কারণ, টাকা ফেরত দিলে রিজার্ভেই চাপ পড়বে। আমদানি-রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ডলারের দামের রেট একটাই হওয়া উচিত। ডলার তো ডলারই। কাউকে বেশি দেবেন, আবার কাউকে কম দেবেন, এটা হতে পারে না। ওয়েজ আর্নার্স বন্ডকে জনপ্রিয় করা প্রয়োজন। এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশ থেকে টাকা আনার কোনো প্রশ্নই আসে না। তারা টাকা দেশে আনা এবং পাঠানো কোনোটাই পারে না। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় দোকানে বিকাশ-রকেটের সাইনবোর্ড টানিয়ে যে টাকা গ্রহণ করা হয়, সেগুলো হুন্ডির মাধ্যমে আসে। সেখানে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো প্রতিনিধি নেই। সমস্যা হলো, সেখানে গিয়ে এসব ঠেকাবে কারা। এসব বন্ধ করার জন্য দেশ দুটির সরকারকে অবগত করতে হবে।

ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রবাসী বন্ডের যে ইন্টারেস্ট সেটা দিলে এখন আমাদের খরচ বেড়ে যাবে। আবার আমার রেমিট্যান্সও দরকার। প্রবাসীদেরও দেখা দরকার। পুরো জিনিসটা ভালো করে দেখতে হবে কীভাবে করা যায়। প্রবাসী বন্ড বৈদেশিক মুদ্রার ভালো একটা উৎস ছিল। যা এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন। একটা ব্যালেন্স করা যায় কি না দেখতে হবে- যাতে বিনিয়োগও আসে আবার খরচও না বাড়ে। সে রকম একটা কিছু করতে হবে।

জানা যায়, সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় বড় বিনিয়োগ নিয়েও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা চোখ রেখেছে কারও কারও প্রতি। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় সম্পদ কেনা নিয়ে তদন্ত হলেও কোনো অর্থ ফেরত আসেনি। তবে আরব আমিরাতকে ঘিরে এখন আলোচনা বেশি। শুধু বড় নয়, মাঝারি পর্যায়ের অনেক ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ ঘাঁটি করেছে দুবাইতে। আলো ঝলমলে দুবাইয়ের আবাসন ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তারা কিনে নিচ্ছেন। দুবাইয়ের ইংরেজি ভাষার টেলার রিপোর্ট এবং আরবি ভাষার ইমারাত আল ইউমের প্রতিবেদন বলছে- করোনা মহামারির পর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুবাইয়ের আবাসন খাতে বাংলাদেশিরা ১২৩ মিলিয়ন দিরহাম বিনিয়োগ করেছেন। করোনার দেড় বছরে এটিই সে দেশে বিদেশি কোনো দেশের নাগরিকদের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা নেদারল্যান্ডসকেও হার মানিয়েছে। নেদারল্যান্ডসের ধনাঢ্যরা ১১৭ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন দিরহামের সম্পত্তি কিনে দ্বিতীয় স্থানে আছেন। আর দুবাইয়ে সুইজারল্যান্ডের নাগরিকরা ১১১ দশমিক ২৫ মিলিয়ন দিরহামের সমপরিমাণ বিনিয়োগ করে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন। চীনের মতো দেশকেও এ ক্ষেত্রে হার মানিয়েছেন বাংলাদেশিরা। চীনের নাগরিকরা ১০৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন দিরহামের সম্পত্তি কিনেছেন। আর জার্মানির নাগরিকরা ১০৫ মিলিয়ন দিরহামের সম্পত্তি কিনে পঞ্চম স্থানে রয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে এই মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গ্রস ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে যা থাকে সেটিই হচ্ছে নেট রিজার্ভের পরিমাণ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ গ্রসে নয়, নেটে দেখাতে বলেছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১ সালের ২ নভেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। আর গত ২ নভেম্বর ২০২২-এ বৈদেশিক মুদ্রা কমে নেমেছে ৩৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে রিজার্ভ কমছে দ্রুত গতিতে। এক বছরে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার।

জানা গেছে, অব্যাহত ডলার সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে রিজার্ভ ভেঙে বাজারে ডলার ছাড়া হচ্ছে। তবুও দাম কমছে না। সংকটও কাটছে না। ফলে ব্যাংকগুলো সময়মতো এলসি খুলতে পারছে না। এতে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। ডলার সংকটের সবচেয়ে বেশি প্রভাব এখন জ্বালানি খাতে। জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে হু হু করে।


শেয়ার করুন