রাজকীয় ভাঁড় যখন কিংবদন্তির নায়ক!

rony221গোলাম মাওলা রনি

রাজকীয় ভাঁড় বলতে দুই বাংলার লোকজন সাধারণত গোপাল ভাঁড়কেই চিনেন। অন্যদিকে তামাম ভারতবর্ষে মহামতি আকবরের সভাসদ এবং নবরত্ন রাজা বীরবলের রয়েছে ভাঁড় হিসেবে অসাধারণ সুখ্যাতি। আর নাসির উদ্দিন হোজ্জার নামডাক ছড়িয়ে আছে বলতে গেলে সারা দুনিয়ায়। গোপাল ভাঁড় ছিলেন নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ। রাজা বীরবল ছিলেন মস্তবড় পণ্ডিত, রণাঙ্গন বিজয়ী বীর সেনাপতি এবং প্রভাবশালী মন্ত্রী। ভারতবর্ষের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহান সম্রাট আকবর তাকে অতিশয় ভালোবাসতেন এবং সব কাজে তার প্রতি নির্ভর করতেন। তার পরামর্শ গ্রহণ করতেন এবং তার সান্নিধ্যে নিরাপদ বোধ করার পাশাপাশি হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তি অনুভব করতেন। এ কারণে সম্রাটের ফতেপুর সিক্রির রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে রাজা বীরবলের জন্য আলাদা প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল। এবার নাসির উদ্দিন হোজ্জা সম্পর্কে কিছু বলি। তিনি ছিলেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর নামকরা মরমি সুফি। পারস্য, তুুর্কি, মধ্য এশিয়া ট্রান্স অক্সিয়ানার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তিনি ভ্রমণ করতেন। সেসব দেশের রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহ এবং সাধারণ জনগণ তীর্থের কাকের মতো নাসির উদ্দিন হোজ্জার আগমন প্রতীক্ষায় থাকতেন। তার কথা শুনতেন, উপদেশ গ্রহণ করতেন এবং হৃদয়-মনে পুলক অনুভব করতেন।

গোপাল, রাজা বীরবল এবং নাসির উদ্দিন হোজ্জা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর আমার অবাক হওয়ার মাত্রা বহুগুণে বেড়ে গেছে। আমি এ কথা ভেবে কিছুতেই কোনো কূলকিনারা পাই না— কেন ইতিহাসের তিনজন কিংবদন্তিকে ভাঁড় বানানো হলো। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে ভাঁড় সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দিয়ে নেই। বাংলা অভিধানে শব্দটি গুণবাচক বা বিশেষণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এটির অর্থ করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। ছোট আকারের মাটির পাত্র, নাপিতের অস্ত্রের ধার অর্থাৎ ক্ষুর কাঁচির ধারালো অংশ, বিদুষক বা পরিহাস দক্ষ ব্যক্তি, শূন্য অবস্থা বা নিঃস্ব অবস্থা ইত্যাদি বোঝায়। শব্দটি যখন ক্রিয়াপদে রূপান্তর হয় তখন এটিকে ভাঁড়া, ভাঁড়ামি, ভাঁড়াম প্রভৃতি রূপে দেখা যায়। ক্রিয়ারূপে এটির অর্থ যথাক্রমে প্রতারণা করা, ছলনা করা, প্রতারণার উদ্দেশ্যে গোপন করা ইত্যাদি। আজকে আমরা সেই ভাঁড়কে নিয়ে আলোচনা করব যে কিনা লোক হাসানোর মাধ্যমে সবাইকে ধোঁকা দিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে। অন্যদিকে রাজনীতির ভাঁড় নিয়েও সাধ্যমতো আলোচনার চেষ্টা করব।

নাটক সিনেমা কিংবা যাত্রাপালার ভাঁড়গুলোর বেশির ভাগই থাকে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। কেউ কেউ হয়ে থাকেন বামন প্রকৃতির। কেউবা হন অস্বাভাবিক চিকনচাকন-ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী— আবার অতিকায় মোটা আকৃতির বোকাসোকা মানুষরূপে ভাঁড়ামির দৃশ্যেও আমরা অভিনয় করতে দেখি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাঁড়েরা ভিলেন অথবা নায়কের সঙ্গী হিসেবে বাহারি অঙ্গভঙ্গি লম্ফঝম্ফ এবং মজার মজার কৌতুকপূর্ণ চুটকি অথবা সংলাপ উচ্চারণ করে দর্শকদের আনন্দ প্রদান করেন। ভিলেনের কুকর্ম অথবা নায়কের সুকর্ম উভয় ক্ষেত্রেই ভাঁড়েরা তাদের চাতুর্য, প্রতারণা এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির বিষয়গুলো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন। নায়কের সঙ্গে নায়িকার মিলন ঘটিয়ে দেওয়ার ফাঁকে নায়িকার বান্ধবী বা কাজের লোকের সঙ্গে ভাব জমানোর তিড়িংবিড়িং কীর্তি কাহিনী দর্শকদের ভারি আনন্দ প্রদান করে। ফলে কোনো কোনো সিনেমায় নায়ক-নায়িকার চেয়ে ভাঁড় বা ভাঁড়িরা অধিকতর জনপ্রিয়তা পেয়ে বসে। গল্প, নাটক-যাত্রাপালায় ভাঁড়দের যেভাবে উপস্থাপন করা হয় ঠিক সেভাবে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে ওদের অস্তিত্ব না থাকলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা কিন্তু বেশ দাপটের সঙ্গেই দেশ-জাতির দুই-একজনকে বিনোদনে ভাসিয়ে বাকি সবার সর্বনাশ ঘটিয়ে থাকে। ইতিহাসের কিংবদন্তি ভাঁড়দের সঙ্গে বর্তমানের রাজকীয় ভাঁড়দের রয়েছে বিস্তর অমিল। বর্তমানের ভাঁড়েরা মোটেও বীর নয়— বরং তাদের কাপুরুষতার বাহারি ধরন দেখে প্রকৃতির ভীতুমার্কা প্রাণীগুলো হেসে গড়াগড়ি দেয়। তারা রাস্তায় চলতে গিয়ে রিকশার টায়ার ফাটার শব্দ শুনলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে— আর ঘরের মধ্যে গিন্নিদের ভয়ে নিজের জীবনের সব কুকর্মের কথা ফটাফট বলে দেয়। তারপর অনুশোচনা করার জন্য বেরিয়ে পড়ে জায়গা-বেজায়গার খোঁজে। দিন শেষে কিংবা রাত শেষে তারা আবার যখন গৃহে ফিরে আসে তখন সেখানে সৃষ্টি হয় নানান হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। তারা শারীরিকভাবে যতটা না অক্ষম তার চেয়েও বেশি অক্ষম মানসিক দিক দিয়ে। তারা যার তাঁবেদারি করে তার সর্বনাশ না ঘটা পর্যন্ত ভাঁড়ামি বন্ধ করে না। বর্তমান ভাঁড়েরা যুদ্ধ করতে জানে না— তারা খুব ভালো করে জানে কী করে দৌড়াতে হয় কিংবা পালানো যায়। বর্তমানের রাজকীয় ভাঁড়েরা মানুষের বিরক্তি, ঘৃণা এবং ক্রোধের অনলে দিন-রাত ঘি ঢালতে থাকে। তারা তাদের আরাধ্য রাজাকে সুপরামর্শ দিতে জানে না— রাজার মনমানসিকতাকে ভালো কর্মের দিকে টেনে আনার কোনো কৌশল তারা রপ্ত করেনি।

রাজাকে বিপদমুক্ত করার কোনো দক্ষতা যেমন তাদের নেই তেমনি রাজার বিপদে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকার সাহসের কথা তাদের অভিধানে নেই। অথচ ইতিহাসের রাজকীয় ভাঁড়েরা শত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও তাদের নিয়োগকর্তাকে কীভাবে রক্ষা করেছেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে গোপাল ভাঁড়ের জীবনীতে— গোপাল ভাঁড়ের মালিক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নদীয়ার শাসক ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং জটিল রাজনৈতিক খেলাগুলো তখনকার সুবে বাংলা অর্থাৎ বাংলা-বিহার এবং উড়িষ্যাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছিল। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতার পালাবদল এবং বহুমুখী দেশি-বিদেশি চক্রান্ত দিল্লির মোগল সিংহাসন পর্যন্ত নাড়িয়ে দিচ্ছিল। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রাজত্ব আরম্ভ করেন ১৭২৮ সালে এবং ৫৪ বছর রাজত্ব করার পর মারা যান ১৭৮২ সালে। তার শাসনামলে নবাব সিরাজ উদ্-দৌলার পতন হলেও তিনি কৌশলে নিজের ক্ষমতা বজায় রাখতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে মীরজাফর এবং মীর কাসিম শত চেষ্টা করেও রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি বাংলার নবাবের দরবারের শক্তিশালী আমাত্যদের হাতে রেখে ইংরেজ শাসক লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন। অন্যদিকে দিল্লির মোগল সম্রাটের সঙ্গেও সুসম্পর্ক স্থাপন করে নিজ রাজ্য এবং প্রজা সাধারণকে নিরাপদ রাখতে পেরেছিলেন।

ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সব সময় গোপালের পরামর্শ মেনে চলতেন। গোপালকে বলা হতো তার দরবারের নবরত্ন। গোপালের পরামর্শে তিনি এমন কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন যার ফলশ্রুতিতে অতি ক্ষুদ্র একটি অঞ্চলের সামন্ত রাজা হওয়া সত্ত্বেও গোপাল নিজেকে সর্ব ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের একজন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেন। অন্যদিকে তার নিজ রাজ্য তো বটেই পুরো বাংলা বিহার এবং উড়িষ্যায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন দেবতার অবতার রূপে। মহাকবি এবং সাধক রাম প্রসাদ ছিলেন তার সভাকবি। গোপালের পরামর্শে এবং রাজার নির্দেশে রাম প্রসাদ অসাধারণ সব কথামালা এবং সুরের সমন্বয়ে ভক্তিমূলক ধর্মীয় গান রচনা করলেন। শত শত বা হাজার হাজার নয়, লক্ষ মানুষ বন্যার ঢলের মতো ছুটে আসত রাম প্রসাদের গান শোনার জন্য এবং সমাবেশস্থলে এসে রাজাকে প্রণাম করে তাকে দেবতার অবতারের আসনে বসিয়ে ফিরে যেত আপন আলয়ে। রাজা অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গোপালকে স্মরণ করতেন। গোপালের জীবদ্দশাতেই তার একটি মূর্তি বানিয়ে রাজা তার রাজপ্রাসাদে সেই মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। দেশ বিদেশের পর্যটকরা আজও গোপালের সেই মূর্তি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন। এবার রাজা বীরবল সম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়া যাক। সম্রাট আকবর তাকে রাজ দরবারের গায়ক এবং সভাকবি হিসেবে নিয়োগ দান করেন ১৫৫৬ সালে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী হিসেবে সম্রাটের নবরত্ন সভায় স্থান করে নেন। একজন বেসামরিক ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও সম্রাটের নির্দেশে তিনি বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করে সফল হন। ফলে সম্রাট তার অধীনে দুই হাজার বেতনভুক মোগল সেনা ন্যস্ত করেন। একজন বেসামরিক মন্ত্রীর জন্য এটা ছিল বিরল এক সম্মান এবং প্রাপ্তি।

রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিষয়াদি, পারিবারিক সমস্যা এবং মানসিক সমস্যা নিয়ে সম্রাট যখন হাবুডুবু খেতেন তখন রাজা বীরবলের বুদ্ধি, পরামর্শ এবং ভরসা তাকে যারপরনাই অনুপ্রাণিত করত। বীরবল যদি সম্রাটের কাছে থাকতেন তাহলে সম্রাটের মনে হতো তিনিও আলেকজান্ডারের মতো বিশ্বজয় করতে পারবেন। যে কোনো কঠিন, মর্মান্তিক এবং অপ্রিয় বিষয়সমূহকে বীরবল এত চমৎকার করে উপস্থাপন করতে পারতেন যার তুলনা পৃথিবীতে বিরল। তিনি সম্রাটের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারতেন তার মনের অবস্থা এবং ইচ্ছার কথা।

সম্রাট আকবর এক সময় মারাত্মক মানসিক সমস্যায় পড়লেন। বিশেষত তার দুধভাই এবং দুধ মায়ের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এবং খবরদারি তাকে অস্থির করে তুলল। বৈরাম খানের বিদ্রোহ এবং ঔদ্ধত্য সম্রাটকে আরও বিপদের মধ্যে ফেলে দিল। অন্যদিকে শাহজাদা সেলিমের বাড়াবাড়ি, দরবারের হিন্দু এবং মুসলমান আমির ওমরাহদের কলহ-বিবাদ ইত্যাদি কারণে সম্রাট প্রায়ই মনমরা হয়ে বসে থাকতেন। ঠিক এই সময়টাতে বীরবল তার জীবনে ধ্রুবতারা হিসেবে আবির্ভূত হন। বীরবলের কথাবার্তা, আচরণ, বুদ্ধি-পরামর্শ সম্রাটকে এতটাই উত্ফুল্ল করে তুলত যে, সম্রাট এক মুহূর্তের জন্য বীরবলকে দূরে রাখতে চাইতেন না। বীরবলের আরেকটি সাফল্য ছিল দরবারের ছোট-বড় সবার সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তোলা। সাধারণত কোনো রাজা-বাদশাহ-সম্রাট যদি কাউকে ভালোবাসেন তবে সেই ব্যক্তিকে অন্য সবাই হিংসা করে থাকে। বীরবলের সঙ্গে মোগল রাজ দরবারের রাজ আমাত্যদের কারও তেমন বিরোধ ছিল না— উল্টো সবাই তাকে ভালোবাসতেন। এ অবস্থায় সম্রাটের মানসিক শান্তির জন্য রাজ আমাত্যদের পরামর্শে শাহী হেরেমের সঙ্গে বীরবলের জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল।

আমরা আজকের নিবন্ধের একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। ফলে নাসির উদ্দিন হোজ্জা সম্পর্কে আজ আর আলোচনার সুযোগ হলো না। তার জীবনের যে বিশাল প্রাপ্তি এবং ব্যপ্তি তা যদি অতি সংক্ষেপেও আলোচনা করা হয় তাহলে একটি নিবন্ধের পুরো জায়গাজুড়ে কেবল হোজ্জার ইতিকথা জ্বলজ্বল করবে। আগামীতে সময় ও সুযোগ হলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখব। আজ শুধু রাজা বীরবল এবং আকবরের বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় একটি কাহিনী বলে নিবন্ধের ইতি টানব।

উত্তর প্রদেশের কালপি নগরীর অদূরে যমুনা নদীর তীরে সম্রাট আকবর তাঁবু ফেললেন। এলাকাটি থেকে সামান্য দূরের এক অজপাড়াগাঁ ছিল রাজা বীরবলের জন্মস্থান। সম্রাট এবং বীরবল যমুনার তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটি গ্রাম্য বাজারে গিয়ে পৌঁছলেন। বিকালের উত্তাপবিহীন সোনালি রোদ, যমুনা তীরের মৃদুমন্দ বাতাস এবং ছায়া-সুনিবিড় গ্রাম্য পরিবেশের সহজ সরল প্রকৃতির মাঝে বাজারের দৃশ্যটি সম্রাটের অতিশয় পছন্দ হলো। তিনি উত্ফুল্ল এবং অতি উৎসাহী কিশোরের মতো এক দোকান থেকে অন্য দোকান ঘুরতে লাগলেন এবং একজন উত্তম ক্রেতার ন্যায় পণ্যসামগ্রী উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে দামদস্তুর করতে লাগলেন। একটি তরকারির দোকানে এসে উত্তর প্রদেশের বিশেষ আকৃতির এবং বিশেষ রঙের তরতাজা বেগুন দেখে সম্রাট ভারি আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তিনি কয়েকটি বেগুন হাতে নিয়ে শিশুর মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বীরবলকে জিজ্ঞাসা করলেন— এগুলো কি?

বীরবল সম্রাটের হাসিমাখা আনন্দময় অভিব্যক্তি দেখলেন। কয়েকটি বেগুনকে কেন্দ্র করে সম্রাট যে সুখ এবং শান্তির সন্ধান পেয়েছেন বীরবল তা বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে চাইলেন। তিনি বললেন— হুজুর এগুলোর নাম বাগুন। সাধারণ বেগুন থেকে এগুলো আলাদা। বাগুনের অনেকগুণ। এগুলো ভাজি করে খেলে এই হয়— ভর্তা করলে ওই হয়। আবার চিংড়ি মাছ দিয়ে ঝোল করে রান্না করলে যা হয় তার চেয়ে বেশি হয় পাঁচমিশালি গুঁড়া মাছ দিয়ে চচ্চড়ি করে খেলে। এর গুণের কোনো শেষ নেই বলেই একে বলা হয় বাগুন। সম্রাট বেশ কিছু বাগুন কিনলেন এবং রাতে আচ্ছামতো বাগুনের তরকারি দিয়ে ভাত খেলেন।

সম্রাটের শরীরে অ্যাজমা এবং অ্যালার্জির প্রকোপ ছিল। সারা রাত তিনি চুলকানির যন্ত্রণায় একটুও ঘুমোতে পারলেন না। সকালে দেখলেন শরীরের অনেক অংশ ফুলে গেছে এবং কিছু অংশ লাল হয়ে গেছে। তিনি বীরবলকে ডেকে পাঠালেন। বীরবল এলে তিনি প্রশ্ন করলেন— আমাকে কি খাওয়ালে। ওইগুলো কিসের বাগুন? বীরবল বললেন— হুজুর ওগুলো সম্ভবত বাগুন ছিল না। ওর নাম বেগুন— বেগুনের কোনো গুণই নেই। বেগুন খেলে চুলকানি হয়, বদহজম দেখা দেয়, মেজাজ খিটখিটে হয় এবং শরীরে কোষ্ঠকাঠিন্য প্রবল আকার ধারণ করে। বীরবলের কথা শুনে সম্রাট ভারি আশ্চর্য হয়ে বললেন, তুমি তো দেখছি বড়ই অদ্ভুত লোক বীরবল। গতকাল কি বললে— আর আজ কি বলছ?

একই মুখে দুই কথা! বীরবল উত্তর করলেন— হুজুর গতকাল বিকালে আপনার যে অনাবিল আনন্দ দেখেছি তা ধরে রাখার জন্য আমি বে’র পরিবর্তে শুধু বা যুক্ত করেছি। সারা বিকাল থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যে প্রশান্তি আপনি অনুভব করেছেন সে তুলনায় বে থেকে বা করায় বেগুনের কোনো ক্ষতিই হয়নি। হুজুর! আপনার চাকরি করি তাই বেগুনের স্বার্থ দেখিনি— আপনার আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করার জন্য ওভাবে বলেছি। তবে বিশ্বাস করুন— আমি যদি বেগুনের চাকরি করতাম তবে অবশ্যই বে’র স্থলে বা বসাতাম না।

লেখক : কলামিস্ট।


শেয়ার করুন