রহিমা বাপের স্কুল নীবরে শতবর্ষে পদার্পন

440f3e3d-1424-4f7c-bd35-11d78a501b64কাফি আনোয়ার

একদিন শতবর্ষ আগে,চঞ্চল পুলকরাশি, কোন স্বর্গ হতে ভাসি, নিখিলের মর্মে আসি লাগে, নবীন ফাগুন দিন শতবর্ষ আগে কবি গুরু রবি ঠাকুরের এমন আবেগমন্থিত ব্যাকুলতা শতবর্ষ পরে এসেও ম্লান হয়নি, আলোকিত সমাজ গড়ার শতবর্ষ পুরানো প্রত্যয়ে ছেদ ফেলেনি কোন জীর্ণতা, কোন মলিনতা। শত গ্রীষ্মবর্ষা, শত শীতবসন্তের বন্ধনহীন পাখা উড়িয়ে রহিমা বাপের স্কুল আজ শতবর্ষী মাইজপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। কক্সবাজার জেলার প্রাচীন বিদ্যাকুঞ্জ। শতশত কলি থেকে সুশোভিত ফুল সৌরভ ছড়িয়েছে দেশের আনাচে-কানাচে। হারিকেন-লণ্ঠন-কুপির আলো থেকে আধাঁরবিদারী আলোকপুঞ্জে বিকশিত মানবিক সৌন্দর্য্যরে পেলব øিগ্ধতা ।
১৯১৬ সালে যাত্রা। দিনেদিনে হয়ে উঠেছে শিক্ষাসংস্কৃতির পশ্চাৎপদ বৃহত্তর ঈদগাঁও জনগোষ্ঠীর আস্থা ও বিশ্বাসের পাদপ্রদীপ। বিদ্যাশিক্ষার অগ্রমন্যতায় রেখেছে নিরবিচ্ছিন্ন অবদান। যেকারণে কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও-ফরাজীপাড়া সড়ক ও ঈদগাঁও-চৌফলদন্ডী সড়কের সংযোগস্থলে স্থাপিত এই স্কুল জেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
বিগত একশ বছর ধরে চলমান শিক্ষাতীর্থে হারানো শৈশব-কৈশোরের দেদীপ্যমান স্মৃতির নস্টালজিয়ায় যাবর কাটছে শত শত আলোকিত মুখ ,আদর্শ মানুষ, সভ্যতার ভিত গড়ার কারিগর। সৃষ্টি করেছে বহু গুণে গুণান্নিত মনীষি থেকে শিক্ষক, ডাক্তার , প্রকোশলী,সেনাকর্মকর্তা,কবি,সাহিত্যিক,লেখক,সাংবাদিক ও দুঁদে রাজনীতিক। যারা দেশের সেবা ও উন্নয়নে রেখেছে বিশেষ ভুমিকা।
১৯১৫ সালে মাইজপাড়ার বিশিষ্ট জমিদার ও শিক্ষানুরাগী কাইয়ুম উদ্দীন মিয়াজীর উদ্যোগে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৯১৬ সাল থেকে তা কাইয়ুম উদ্দীন মিয়াজীর বড়ভাই ও রহিমা খাতুনের বাবা তমিজ উদ্দীনের তত্ত্বাবধানে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে । পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ওই স্কুলটি রহিমাবাপের স্কুল নামে চারিদিকে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
বাঁশ-কাঠ-ছনের চৌচালা ঘর থেকে উত্তর-দক্ষিনে লম্বালম্বি টিনের চালা স্কুলগৃহ। উত্তর মাইজপাডার আহমদ নবী মাষ্টার ও মোহাম্মদ মাষ্টারের দানকৃত ৩০ শতাংশ জমিতে ১৯৬০ সালের শুরুতে লোহা ইট কংক্রীটের আধুনিক সম্প্রসারিত স্কুলভবনটি নির্মিত হয়। ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে ওই স্কুলভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে ছাদের পলেস্তার খসে পড়তে শুরু করলে তা ভেঙ্গে সৌদি সরকারের আর্থিক অনুদানে বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী নির্মিত হয় সাইক্লোন সেলটার। এটি নির্মাণে জায়গার স্বল্পতা দেখা দিলে পিআইও আমীরুল হক ৪ শতাংশ জমি দান করেন এবং ওই জায়গাতে নির্মিত সাইক্লোন সেলটারটিই রহিমাবাপের স্কুলের বর্তমান সংস্করণ। যা এখনও মাইজপাড়া সরকারী প্রাইমারী স্কুলের চেয়ে রহিমাবাপের স্কুল নামেই বেশি পরিচিত।
কালের দীর্ঘ পরিক্রমার সাক্ষী এই স্কুলটি নীরবে প্রত্যক্ষ করেছে ইতিহাসের নানা ঘাতপ্রতিঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ, পটপরিবর্তন ও উত্তানপতন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর তৃতীয় বিশ্বের ঘুরে দাঁড়ানো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাঢোল,পারমানবিক বোমার বীভৎস্যতার ইতিবৃত্ত, ইংরেজ-পুর্তুগীজ বেনিয়াবর্গীদের লুটপাট ও শোষনের আর্তনাদ, ’৪৭ এর পাকভারত বিভাজন, পাকিস্তানীদের বৈষম্য-নির্যাতন, ’৫২ ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিকামী বাঙ্গালীর স্বাধীনতার লড়াই’সহ ইতিহাসের প্রতিটি পটপরিবর্তনের সাক্ষী এই স্কুল।
স্কুলের জমিদাতা মরহুম মোহাম্মদ উল্লাহ মাষ্টারের নাতী ও এই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক মরহুম মোঃ ইদ্রিচের জ্যেষ্ঠপুত্র জসীম উদ্দীন বলেন, আমিও এই স্কুলের ছাত্র। বাড়ীর পাশের এই স্কুলেই কেটেছে আমার ছেলেবেলা। তিনি বলেন,শুনেছি মাত্র ৫ জন ছাত্র দিয়ে শুরু করে এই স্কুল, যা এখন ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর পদভারে মুখরিত স্কুল প্রাঙ্গণ।
১৯৪৮ সালে এটি পাকিস্তান সরকারের নজরে আসে সেই থেকে জাতীয়করণের প্রস্তাব গৃহীত হলে রহিমাবাপের স্কুলটি মাইজপাড়া প্রাইমারী স্কুল নামধারণ করে। স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও খ্যাতিমান হোমিও চিকিৎসক ডাঃ মুহাম্মদ আলম বলেন, এতদাঞ্চলের শিক্ষাপ্রসারের বাতিঘর এই স্কুল। স্কুলের জ্বালানো মশালের আলোতে আলোকিত হয়েছে পুরো এলাকা, গড়ে উঠেছে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি। শতবর্ষে পদার্পন গর্বিত করেছে এলাকার সবশ্রেণী পেশার মানুষকে। এটি আলো ছড়াবে আরো হাজার বছর। একুশে পদক প্রাপ্ত জাতিসত্ত্বার কবি মুহম্মদ নুরুল হুদাও এই স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনা করেছেন বলে জানান তিনি জানান।
স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ কামরুল আজাদ জানান , মাইজপাড়ার প্রাইমারী স্কুলের কৃতিত্ব ও সাফল্য ছিল এই অঞ্চলের সবার জন্য ঈর্ষনীয়। গৌরবময় সাফল্যের ধারাবাহিকতায় শতবছর পার করছে এই স্কুল যা সকলের জন্য গর্বের ও মর্যাদার ।
স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী জাফর আলম (এম এ ) বলেন , শতবর্ষী স্কুলের ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ করেছে এ অঞ্চলের শিক্ষাদীক্ষাসংস্কৃতিকে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আত্মিক বন্ধন, আন্তরিকতা ও আনন্দযোগে পাঠদানের পরিবেশ কিছু স্বার্থান্নেষীমহলের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। শতবর্ষ পার করছে নীরবে অথচ কোন উদযাপন নেই। গৌরবের মাঝে এ যেন কলংকতিলক ।
স্কুলের বর্তমান সহকারী শিক্ষক আবদুল আজিজ বলেন , শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটি শতবর্ষ পূর্তি পালনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে। কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াও চুড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
প্রাক্তন ছাত্র ,সাবেক ছাত্রনেতা সৌদি প্রবাসী সেলিম উল্লাহ বলেন , এই স্কুলের সাথে শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে , শতবর্ষে পদার্পনের মুহুর্তে ফেলে আসা স্মৃতিগুলি যেনো ফিরে ফিরে আসছে বার বার ।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মাষ্টার মনসুর আলম জানান, এই স্কুল শত শত মেধাবী ও প্রতিভা আবিষ্কার করেছে যাদের দ্যোতিতে আলোকিত দেশসমাজবিশ্ব। জমকালো আয়োজনে উদযাপিত হোক স্কুলের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান।
স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী, বর্তমানে ইউনির্ভাসিটি অব লন্ডনে ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজির এম ফিল গবেষক, লন্ডনপ্রবাসী সানজিদা তাজ জেবিন জানান, বেড়ে উঠার সাথে এই স্কুলের স্মৃতিগুলি সবসময় প্রাণবন্ত। শতবর্ষে পদার্পন করা যেকোন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানের জন্য যেমন গৌরবের তেমনি সংশ্লিষ্টদের জন্য গর্বের ও আনন্দের।
মাইজপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় শত বছরের চড়াই-উতরাই মাড়িয়ে এক শতাব্দী থেকে অন্য শতাব্দীতে পদার্পন করে করেছে ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে । রহিমা বাপের সুদুরপ্রসারী ও মানবহিতৈষী কীর্তি আজ জেলার প্রাচীন বিদ্যাবাগে পরিণত হয়েছে। মানুষের হূদয়ে মহানুভবতার নিদর্শন ও শিক্ষাসারথী হয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকবে রহিমাবাপের উদ্দম ও উদ্যোগ।
স্কুলের বর্তমান কর্তৃপক্ষ এগিয়ে এসে শতবর্ষপূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্যোগ নিলে হয়তোবা লোকচক্ষুর অগোচরে থাকা শত শত রহিমা বাপেরাও অনুপ্রাণিত হবে।
অনাগত আমাদের দক্ষিণ-দুয়ারী
বাতায়ন খুলি তুমি ,
এসো হে গোপন , হে স্বপনচারী ।


শেয়ার করুন