যে লাউ সেই কদু

একটু দূরেই পদচারী-সেতু। তা ব্যবহারের গরজ নেই পথচারীর। মতিঝিল, ঢাকা।

সাইফুল সামিন

সাড়াজাগানো ‘বিপ্লব’ তো হলো। কিন্তু ফলাফল কী? গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, সড়কের অবস্থা ‘যে লাউ সেই কদু’।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিশু-কিশোর-তরুণদের তুমুল আন্দোলন দেখে আমরা বড়রা আশায় বুক বেঁধেছিলাম। সবাই বাহবা দিয়ে বলছিল, বাচ্চারা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, পথ দেখিয়েছে। মাত্র কদিনেই তারা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, কী করে সড়ক সামলাতে হয়। এবার সড়কে শৃঙ্খলা আসবেই!

কিসের কী? শিশু-কিশোরেরা ঘরে ফিরতে না ফিরতেই সড়ক আগের মতোই ‘মগের মুল্লুক’। বলা চলে, আন্দোলনকালে কিছুটা বিরতি ছিল মাত্র। বিরতি শেষে সড়কে বিশৃঙ্খলা এখন বহাল তবিয়তে। কি চালক, কি পথচারী—সবাই দারুণ উদ্যমে পুরোনো অভ্যাসে ফিরে এসেছে। সড়কে যে যার মতো করে চলছে। শিশু-কিশোরেরা এত বড় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গেল অথচ কয়েক দিনের ব্যবধানে তা বিস্মৃত। কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

চালক, যাত্রী কিংবা পথচারী—কাকে দোষ দেব? ফেসবুকে কয়েকটা ছবি দেখলাম। ভদ্রলোক, পোশাক-আশাক আর চেহারা-সুরত দেখে অন্তত তা-ই মনে হয়। কাছেই পদচারী-সেতু। কিন্তু ওপথে না গিয়ে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা মাড়িয়ে ওপাশে যাওয়ার জন্য হনহন করে হাঁটা ধরলেন তিনি। ঘটনাস্থলে থাকা স্কাউটের এক সদস্য পথচারীকে থামানোর চেষ্টা করলেন। পথচারী সম্ভবত মন ঠিক করে ফেলেছেন। তিনি থামতে নারাজ। গাড়িঘোড়ার ফাঁক গলে রাস্তা দিয়েই যাবেন তিনি। উপায়ান্ত না পেয়ে শেষমেশ পথচারীকে সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরে আটকানোর চেষ্টা করলেন স্কাউটের সদস্য। তারপর কী হলো, তা ছবিতে নেই। তবে এই দৃশ্যগুলো আমাদের পথচারীদের মানসিকতা বলে দেয়। সড়ক পারাপারের ক্ষেত্রে তাঁরা নিয়ম মানতে চান না। আন্ডারপাস ও ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারে তাঁদের রাজ্যের কষ্ট। বাসে ওঠা-নামার বেলায়ও তাঁরা স্টপজের ধার ধারেন না।

চালকদের কথা আর কী বলব! স্টিয়ারিং হাতে নিলে তাঁরা ‘মানুষ’ থেকে ‘চালক’ হয়ে যান। চালকের আসনে বসলে তাঁরা বনে যান রাস্তার রাজা। রাজা তো রাজা, তাঁরা হলেন মহারাজা। ওস্তাদদের খামখেয়ালি আচরণ দেখলে ভয়ে মন দুরুদুরু করে। লাগামছাড়াভাবে গাড়ি চালানো দেখলে মনে হয়, ‘গরু-ছাগল’ চেনার বিশেষ যোগ্যতায় তাঁরা লাইসেন্স পেয়েছেন। বাস, ট্রাক ও পিকআপের অনেক চালক লুঙ্গি পরে গাড়ি চালান। বাস চালানোর সময় চালক তাঁর সহকারী বা পাশের যাত্রীর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেন। রাস্তা ফাঁকা পেলে গতির খেলায় মেতে ওঠেন। বেপরোয়াভাবে ওভারটেক করেন। অন্য গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে অনেকে দানবীয় আনন্দ পান। অহরহ পাশের গাড়িকে চাপ দেন, ঠুসঠাস লাগিয়ে দেন। বাসচালকেরা যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠান ও নামান। ট্রাফিক আইন বলে যে কিছু একটা দেশে আছে, তা চালকদের দেখলে মনে হয় না। মোটরসাইকেল চালক বলুন, আর বাসচালক বলুন, মোটামুটি সবার মনোভাবই প্রায় একই।

ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে পড়ে যান এই যাত্রী। কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত বাসে উঠতে গিয়ে পড়ে যান এই যাত্রী। কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
আমরা বারবার বলছি, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর আইন দরকার। একই সঙ্গে দরকার আইনের শক্ত প্রয়োগ। কিন্তু আইন দিয়ে যে সবকিছু অর্জন করা সম্ভব নয়, তার প্রমাণ আমরা গত কয়েক দিনে পেয়েছি।

ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সাত দিনের ট্রাফিক সপ্তাহ ১০ দিন হলো। ১০ দিনে সারা দেশে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। জরিমানা আদায় হয়েছে ৭ কোটি ৮ লাখ টাকা। ৭৪ হাজার চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আটক সাড়ে পাঁচ হাজার যানবাহন।

বোঝাই যাচ্ছে, ট্রাফিক সপ্তাহে পুলিশের অবস্থান বেশ কঠোর ছিল। কিন্তু তাতে কী? মামলা, জরিমানা, যানবাহন জব্দ—কোনো কিছুই প্রত্যাশিত ফল দেয়নি। কড়াকড়ির মধ্যেও ১০ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৩ জনের প্রাণ গেছে। ট্রাফিক সপ্তাহ না থাকলে প্রাণহানির এই সংখ্যা কততে গিয়ে ঠেকত, তা কে জানে!

সবাই বলে—নিরাপদ সড়ক চাই। কিন্তু ট্রাফিক আইন মানার ক্ষেত্রে কেউ নেই। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ট্রাফিক আইন মানে না বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তাঁর পর্যবেক্ষণের সঙ্গে দ্বিমত করার উপায় নেই। রাস্তাঘাটে বের হলে দেখা যায়, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বয়স-শ্রেণি-পেশা-শিক্ষার কোনো ভেদাভেদ নেই।

আসলে সমস্যা হলো আইন না মানার বিষয়টি আমাদের অস্থি-মজ্জার ভেতরে ঢুকে গেছে, অনেকটা জাতীয় চরিত্র হয়ে যাচ্ছে। বলা যায়, নিয়মিত অনিয়ম চর্চার কারণে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, আমরা যে আইন ভাঙছি, তাও অনেকের মনে হয় না। আবার এমনও আছে, অনেকে মনে করে, ধুর, এত আইন মেনে কী হবে!

মানুষের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতার ফল ভয়াবহ। সড়কের বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। খাসলত সহজে যায় না বলে একটা কথা আছে। এ ক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক সেই দশা। আমাদের সড়ককে বিশৃঙ্খলার পেছনে আছে দীর্ঘদিনের খাসলত। এই খাসলত রাতারাতি দূর হয়ে যাবে, এমনটা আশা করা যায় না। এ জন্য গোড়ায় হাত দিতে হবে।

নাগরিকের আইন না মানার প্রবণতার মনস্তত্ত্ব বুঝতে কথা হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলালের সঙ্গে। তিনি মোটাদাগে তিনটি কারণ দাঁড় করালেন। প্রথমত, আমাদের মৌলিক শিক্ষায় গলদ আছে। দ্বিতীয়ত, জবাবদিহির অভাব। তৃতীয়ত, ক্ষমতাবানেরাই আইন মানছেন না। এ অবস্থায় অন্যদের জন্য আইন না মানা ক্ষমতার একটা সূচক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খুবই সত্যি কথা। সবাই এখন শক্তির চর্চা করে। নিজের ক্ষমতা অন্যকে দেখাতে চায়। সড়কও দীর্ঘদিন ধরে শক্তি বা ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সড়কে কেন কোথাও আইন ভাঙার জন্য মানুষ লজ্জিত হয় না, অপরাধবোধে ভোগে না। বরং এ কাজ করে তারা নিজেকে ক্ষমতাশালী ভাবে। তাই নিঃশঙ্কচিত্তে বুক ফুলিয়ে চলে।

ট্রাফিক আইন না মানার পেছনে সিস্টেমে মূল সমস্যা দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন। তাঁর মতে, যাঁরা আইন তৈরি করছেন, যাঁরা ক্ষমতাশালী-অর্থশালী, তাঁরাই আইন মানছেন না। আর ট্রাফিক সিস্টেমটা আইন মানা-বান্ধবও নয়।

মানুষের মধ্যে আইন বা নিয়ম মানার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে শুরুটা পরিবার দিয়েই করতে হবে বলে মনে করেন আহমেদ হেলাল। কারণ, পরিবারই পারে আইন বা নিয়ম মানার শিক্ষাটা শিশুর মনের ভেতর গেঁথে দিতে। এসব ক্ষেত্রে পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে। সঙ্গে কঠোর আইন ও জবাবদিহি তো থাকতেই হবে। আর ট্রাফিক সিস্টেম হতে হবে এমন, যেন তা আইন মানার অনুকূলে থাকে। এ জন্য সিস্টেমকে ঢেলে সাজানো দরকার।

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]


শেয়ার করুন