যে দৃশ্য ভোলার নয়

3_301414এম সাখাওয়াত হোসেন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। আমি ঢাকাস্থ ৪৬তম সেনা ব্রিগেডে মেজর পদবিধারী কর্মকর্তা হিসেবে দু’জন সিনিয়র স্টাফ অফিসারের একজন। তৎকালীন কমান্ডার ছিলেন সদ্যপ্রয়াত কর্নেল সাফায়াত জামিল বিবী। খুব ভোরে রেডিওতে মেজর শরিফুল হক ডালিমের (অব.) সেই মর্মান্তিক অবিশ্বাস্য ঘোষণা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় চিত্তে সঙ্গে সঙ্গে যখন আমার অফিসে পৌঁছলাম তখন কর্তব্যরত করণিক ছাড়া কেউ পৌঁছেনি। পৌঁছানোর কথাও নয়, কারণ অফিস শুরু হতে আরও এক ঘণ্টা বাকি ছিল। যা ঘটেছে বলে শুনেছি তা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর তৎকালীন প্রধান করণিক এসে রেডিও এবং ততক্ষণে আকাশে-বাতাসের নানারকম গুজবের কথা বলল। তার কথা আমার কানে প্রবেশ করছিল না। আমি জানালার বাইরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বসে থাকলাম।

আরও ঘণ্টাখানেক পর তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার তার অফিসে এলেন। তার কিছুক্ষণ পরেই আমি ধানমণ্ডি থেকে একটা ফোন পেলাম। অপর প্রান্তে মেজর হুদা, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকায় যার ফাঁসি হয়, জানাল যে এখানে কয়েকটি পত্রিকা ও বিটিভির ফিল্ম রোল রয়েছে সেগুলো যেন ব্রিগেড তাৎক্ষণিকভাবে সংগ্রহ করে। আমি কমান্ডারকে ফোনের কথোপকথনের বিষয় জানালাম। তখনও কমান্ডার ছাড়া আমিও একমাত্র কর্মকর্তা ছিলাম। তিনি আমাকেই যেতে বললেন। আরও বলেছিলেন, সুযোগ পেলে জেনে আসতে কি হয়েছিল এবং পারলে ভেতরে দেখে আসতে। তিনি কিছুতেই বঙ্গবন্ধুর এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারছিলেন না।
আমি কমান্ডারের হুকুম মোতাবেক ফিল্মগুলো নিয়ে আসতে বের হলাম। রাস্তায় কোনো যানবাহন বা মানুষ নেই। মনটা কেমন যেন বিক্ষিপ্ত এবং আতংকগ্রস্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু নেই, দেশের কি হতে যাচ্ছে। অবশেষে বাড়ির সামনে পৌঁছলাম। ওখানে কর্তব্যরত সামরিক কর্মকর্তা আমার হাতে ফিল্মগুলো দিয়ে বললেন, তিনি কিছুক্ষণ আগেই এখানে এসেছেন গার্ড হিসেবে। আমাকে নিয়ে গ্যারেজের কাছে এলে দেখলাম আমার অতি পরিচিত কর্নেল জামিলের বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ তার গাড়ির পেছনের সিটে উপুড় করে রাখা। হৃৎস্পন্দন বাড়তে লাগল। কর্নেল জামিল আমার অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হল না। চুপচাপ ওই কর্মকর্তার পেছনে হাঁটতে লাগলাম।
জামিলের মৃতদেহের পাশ কাটিয়ে নিচতলার প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়াতেই আমার সঙ্গে যে অফিসারটি ছিল, সে আমাকে ভেতরে ঢুকে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখে আসতে বলল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড শেষ হয় ভোর আনুমানিক ৫.৩০ মিনিটের মধ্যে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে সমস্ত বাড়ি ঘুরে দেখানোর দায়িত্বও সে নিল। প্রসঙ্গত এ অফিসারই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পাহারারত ১ম আর্টিলারি ইউনিটের সৈনিকদের কমান্ডার ছিল, সে রাতে সেনানিবাসে অফিসার মেসে থাকত। ভোরের দিকে তাকে নিয়ে এসে বাড়ির চার্জ দেয়া হয়। সামরিক অফিসারদের (অভ্যুত্থানে জড়িত অফিসাররা বাদে) মধ্যে যাকে প্রথম বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভেতর দেখার প্রস্তাব শুনে কেন জানি না মনে এক সংশয়ের জন্ম নিল; ভেতরে যাব কী যাব না। পরে ভাবলাম গিয়ে দেখাটাই সমীচীন হবে কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের এ রক্তাক্ত অধ্যায়ের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনার শেষ অংকটির যবনিকা পড়ার পরও দেখতে পারাটা একটা ঐতিহাসিক সত্য হয়ে সারা জীবন থাকবে। তাই কিছুটা যন্ত্রচালিতের মতো দরজার বাইরের কলাপসিবল গেট পার হয়ে সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল। নাকে বারবার মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছিলাম। বারুদের গন্ধ আর মৃত্যুর নিস্তব্ধতা মিলে অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি করছিল। অন্তরে ভীষণ বেদনা আর শরীরে বিষণ্ণতা গ্রাস করতে লাগল। সব মিলিয়ে মনে হল এক মৃত্যুপুরীর মধ্যে এসে পড়েছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের জাতির জনক আর রাষ্ট্রপতির বাড়ির এ গেট দিয়ে ঢুকতে অনেকেরই সৌভাগ্য হয়নি। বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক যার সান্নিধ্যে বা কাছে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত, আর আজ এ মুহূর্তে সেই বাড়ির ভেতরে মৃত্যুর নিস্তব্ধতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। ভাগ্যের কী নির্মম খেলা, যার তর্জনী হেলনে বাংলার মানুষ জীবন দিতেও কার্পণ্য করেনি তারই মৃতদেহ দেখার জন্য নেই কোনো ভিড়, নেই কোনো জনসমুদ্র, নেই কোনো ক্রন্দন, মরসিয়া বা মাতম।
ভেতরে ঢুকতেই সিঁড়ির গোড়ার রুমে সেদিন রাতে ডিউটিরত পুলিশ ইন্সপেক্টরের মৃতদেহ সামনের টেবিলের ওপর রক্ষিত টেলিফোনগুলোর ওপরে উবু হয়ে পড়ে থাকতে দেখি। টেবিলটি রক্তে একাকার হয়ে গেছে। পরে জানতে পারলাম বাড়ির ভেতরে প্রবেশের মুখে কলাপসিবল গেটের তালার চাবি দিতে অস্বীকার করায় তালা ভেঙে ফেলার পর প্রথমেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইউনিফর্ম পরা এই পুলিশ অফিসার আরেক ব্যক্তি যিনি নিজের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে প্রাণ দিলেন। জানি না এ অজানা পুলিশ অফিসার কোনোদিন বাংলার ইতিহাসে স্থান পাবেন কিনা, না হারিয়ে যাবে তার নাম, নাম না জানা এ দেশের অগণিত শহীদের মতো। ইতিহাসে স্থান পাক আর না পাক একজন পুলিশ অফিসার রেখে গেলেন কর্তব্য পালনের এক বিরল দৃষ্টান্ত।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে হাঁটছি। একটু এগোতেই সিঁড়ির ডান দিকে আর একটি বোধহয় গেস্টরুম ছিল। ভেতরে ঢুকে সেখানে দেখলাম বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের আর তার এক সহকারীর বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ। শেখ নাসেরের মৃতদেহ বাথরুমের দরজার সামনে পড়ে আছে। মুখে একটা আতংকের ছাপ। শেখ নাসের আগের দিন খুলনা থেকে এসেছিলেন জনাব সেরনিয়াবাতের মেয়ের গায়ে হলুদ উপলক্ষে। তিনি সেদিন হয়তো জানতেন না এটাই তার ঢাকায় শেষ যাত্রা। একেই বোধহয় বলা হয় অঢ়ঢ়ড়রহঃসবহঃ রিঃয ফবধঃয. এই শেখ নাসের সম্বন্ধে অনেক কিছুই এর আগে শুনেছি। আজ তিনি সবকিছুরই ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তাড়াতাড়ি সে রুম থেকে বের হয়ে উপরের তলায় ওঠার সিঁড়িতে উঠলাম। সিঁড়ির মাঝামাঝি এসেই সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখলাম যা আজও বিশদভাবে স্পষ্ট মনে পড়ে। আর সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর নিষ্প্রাণ দেহ সিঁড়ির উপরে পড়ে থাকতে দেখা। মনে পড়ে ১৯৫৬ সালে আমি যখন নিতান্তই বালক, জীবনে প্রথম তৎকালীন যুবলীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখি রংপুরে যুব উৎসবে যোগদান করতে সেখানে আগমনের সুবাদে। আমার বাবা তখন রংপুরে সরকারি চাকরি করতেন। আমি রংপুর জিলা স্কুলে পড়তাম। তিনি এসেছিলেন আমাদের বাড়িওয়ালার দাওয়াতে। সেখানেই প্রথম দেখলাম একজন প্রাণবন্ত সুপুরুষ বাঙালি, উঠতি রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমানকে। আর আজ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল, তারই বাড়ির দোতলার সিঁড়ির মধ্যপাশে নিষ্প্রাণ সুঠামদেহী বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, পরনে চেক লুঙ্গি, ডান হাত বুকের উপরে বাঁ-হাত ঈষৎ এলানো। কিছু দূরে ছিটকে পড়া তার ব্যবহৃত চশমা। বুক ঝাঁজরা হয়ে গেছে গুলির আঘাতে। সিঁড়ির উপরে চাক চাক রক্ত জমাট বাঁধা। মুখমণ্ডল তেমনি শান্ত। কোথাও কোনো ভয়ের চিহ্ন নেই। দেখে মনে হল মৃত্যুর ছায়াও তার মুখে পড়েনি। তার চেহারার অভিব্যক্তিতে মনে হল তিনি তারই পরিচিত কাউকে সামনে দেখেছিলেন যাকে দেখে হয়তো তিনি বিশ্বাসও করতে পারেননি যে এদের হাতেই তাকে বরণ করতে হবে এক অবিশ্বাস্য রকমের মৃত্যু। স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালি সৈনিকদের গুলির আঘাতে তার জীবনের ইতি হবে এ কথা তিনি বিশ্বাস করা তো দূরের কথা, কল্পনাও করেননি। তার মৃত্যু হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানি সৈনিকদের গুলিতে; কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের সে সাহস হয়নি। তিনি বেঁচে ছিলেন বাংলার মানুষকে স্বাধীন করে স্বাধীন বাংলাদেশে তারই নিজের বাড়িতেই মৃত্যুবরণ করার জন্য।
বঙ্গবন্ধুর দেহের অবস্থান দেখে ভাবলাম, সামনের দিক থেকে গুলি করা হলে সাধারণত উপর থেকে নিচের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ার কথা, কিন্তু তার শরীর চিৎ অবস্থায় কেন। পরে জানতে পারলাম তিনি সিঁড়ির উপরেই ছিলেন এবং গুলি হয়েছে ঋরৎংঃ খধহফরহম থেকে। মুখ থুবড়েই পড়েছিলেন। অতি উৎসাহী অভ্যুত্থানকারী সৈনিকরা তার দেহকে চিৎ করে দেয় তাকে দেখার জন্য।
এক মহান ব্যক্তিত্বের মৃতদেহের পাশে দাঁড়ানো আমি। এক অস্বস্তিকর সময় অতিক্রম করছিলাম, বঙ্গবন্ধু- যাকে জাতির পিতা হিসেবেই জেনেছিলাম, তার মৃতদেহ এভাবে অযত্নে পড়ে আছে যার ভাগ্যে একটা চাদরও জুটল না দেহ ঢাকার জন্য, যার নাকি প্রাপ্য ছিল জাতীয় পতাকার মর্যাদা।
আমি বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহের সামনে আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না। বুকের ভেতরে কেমন একটা অস্থিরতা লাগছিল। উপরে উঠতে হলে বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহকে ডিঙ্গিয়ে যেতে হবে যা খুবই অমর্যাদাকর হবে মনে করে কোনো রকমে দেয়ালের সঙ্গে ঘেঁষে উপরে চলে এলাম শেখ সাহেবের শয়নকক্ষের দিকে। অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের শয়নকক্ষ। তাতে একটি ডাবল খাট পাতা, পাশে একটি আলমারি, তারপর খুব একটা বেশি ফাঁকা জায়গা ছিল না। কোনায় একটি টেবিলের উপরে রাখা গোটা তিনেক ফোন যার ভেতরে লাল ফোন, যেটা দিয়ে সকালে তিনি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাইড টেবিলে আরও কয়েকটি পাইপ আর তার শখের এরিনমোর পাইপ টোবাকো। লক্ষ্য করলাম সিঁড়ি থেকে এ ঘর পর্যন্ত রক্তে রক্তে ছেয়ে গেছে। প্রায় শুকিয়ে ওঠা রক্তের গন্ধ ঘেঁটে যেতেই কেমন অসহ্য লাগল। অনেক বুটের দাগ। মনে হল সৈনিকদের চলাচলে এগুলো হয়েছে। মাস্টার বেডরুমের মধ্যেই পরিবারের নিহত সব মৃতদেহই দেখলাম। হয়তো একই রুমে সবাইকে হত্যা করা হয়েছে অথবা দু-একজনের মৃতদেহকে একত্র করার জন্য এক রুমেই নিয়ে আসা হয়েছে।
বেডরুমে ঢোকার মুখেই বেগম মুজিবের মৃতদেহখানি দেখলাম। একটু পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কামাল, জামাল আর তাদের সদ্য বিবাহিত বধূদ্বয় এবং সবার শেষে কোনার দিকে অবুঝ শিশু রাসেলের মৃতদেহ। রাসেল বঙ্গবন্ধুর ছোট সন্তান বলেই তাকে আদরও করতেন অনেক বেশি। রাসেলের মৃতদেহ দেখেই আমার ভীষণ প্রতিক্রিয়া হল। মনটা বেদনায় ভারি হয়ে উঠল। এ অবুঝ শিশুর প্রাণ হরণ করার কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে! পরে আমাকে আমার পাশে দাঁড়ানো অফিসারই জানাল যাতে কোনো চাক্ষুষ প্রমাণ না পাওয়া যায় সেজন্যই সবাইকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। এ কথার কতখানি যৌক্তিকতা আছে তা ভেবেই দেখিনি সেদিন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার, নিরাপত্তা বিশ্লেষক


শেয়ার করুন