যে কারণে সক্রিয় আশরাফ

Syed-Ashraf-351x185কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত দলকে ঐক্যবদ্ধ ও গতিশীল করার ‘মিশন’ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এই মিশন অনুযায়ী তিনি সরকার ও দলের ভেতরের সমন্বয়হীনতা দূর করার উদ্যোগ নেবেন। এ ব্যাপারে মনোযোগী হতে সৈয়দ আশরাফকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্দেশনা অনুযায়ী দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙে দলে ও সরকারে সমানভাবে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন তিনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতা ও সরকারের একাধিক মন্ত্রী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র মতে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের রাজনীতি এক ধরনের তাল-লয়হীন হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে দলে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনা জরুরি। তাই দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদককে। নীতি নির্ধারণী নেতাদের মতে, মধ্যবর্তী নির্বাচনের গুঞ্জনও রয়েছে। এটাও আশরাফের সক্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। এরই অংশ হিসেবে দলীয় কার্যালয়ে যাতায়াত, মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিতির হার বাড়িয়েছেন সৈয়দ আশরাফ। পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ, রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোয় অংশগ্রহণ আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেড়েছে।
আওয়ামী লীগের দফতর সূত্রে জানা যায়, আশরাফ শুধু কার্যালয়ে আসছেন তাই নয়, নেতাকর্মীরা তার কাছে ভিড়তে পারছেন। তাদের কাছ থেকে নানা সমস্যার কথাও শুনছেন। শিগগিরই সাংগঠনিক জেলা সফরেও বের হবেন আশরাফ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দফতর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ বলেন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ধানম-ির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এখন প্রায় নিয়মিত বসছেন। নেতাকর্মীরা তার সাক্ষাৎ পাচ্ছেন, কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দলের নানা বিষয় নিয়ে খোঁজখবরও নিচ্ছেন তিনি।
এদিকে, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও তার নিজের কর্মকা-কে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন। শুক্রবার এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘এখানে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয়ের প্রশ্ন কেন আসছে? দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব রয়েছে, সেই দায়িত্বই শুধু পালন করছি আমি। এর বেশি কিছু নয়।’
আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর এক সদস্য বলেন, গত ১ আগস্ট দলের সকল কেন্দ্রীয় নেতা একসঙ্গে, এক বাসে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার ঘটনা নিকট অতীতে নেই। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে নানা দূরত্ব, মত ও পথের পার্থক্য থাকায় এর আগে এ ধরনের যাত্রা হয়নি। মূলত দলীয় নেতাদের ভেতরে ঘনিষ্টতা বাড়াতে এবার গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে ফুল দিতে যাওয়া হয় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমভাবে। ওই নেতার দাবি, এই এ ধরনের ভিন্নমাত্রায় টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন সৈয়দ আশরাফ।
রাতারাতি বদলে যাওয়া এবং দলীয় কর্মকা-ে সৈয়দ আশরাফের সাম্প্রতিক ব্যস্ততায় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাও অনেকটা আশ্চর্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সভাপতিম-লীর এক সদস্য বলেন, দুদফায় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। সম্ভবত গত এক মাসে সৈয়দ আশরাফ যতদিন মন্ত্রণালয়ে ও রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়েছেন, তাতে গত ৫ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন।
তবে ওই নেতাদের মতে, দল ও সরকার যখনেই বিপদের মুখে পড়েছে, সৈয়দ আশরাফ চালকের আসনে আসীন হয়েছেন। তাদের দাবি, বিগত সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দল যখন চরম বিপর্যয়ের মুখে, তখন আশরাফ তার দায়িত্বশীলতা প্রমাণ রেখেছেন। হেফাজতের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও এ বছরের বিএনপির ‘অল আউট’ আন্দোলনেও তিনি ভুমিকা রেখেছেন।
সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধে ৬ মাসে একবারও দলীয় কার্যালয়ে না যাওয়ার অভিযোগ খোদ দলের নেতাদেরই ছিল। সেই সৈয়দ আশরাফ গত এক মাসে অন্তত ১০ দিন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ধানম-ির রাজনৈতিক কার্যালয়ে অফিস করেছেন। দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন নেতাকর্মীদের সঙ্গে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকসহ মন্ত্রণালয়ে গিয়েছেন নিয়মিত। রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোয়ও তার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাধিক মত-বিনিময় ও যৌথসভা করেছেন। চলমান রাজনীতি ও ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎ বার্ষিকী সামনে রেখে কয়েকদিন আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করেছেন।
দলীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, সৈয়দ আশরাফ দেখভাল করছেন সাংগঠনিক জেলার রাজনীতি। পাশাপাশি সরকারের হয়ে আন্তর্জাতিক বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটাতে নিয়মিত যোগাযোগ চলছে তার। সর্বশেষ ৭ আগস্ট (শুক্রবার) বাংলাদেশে সফররত ভারতের রাজনৈতিক দল বিজেপির মুখপাত্র ড. বিজয় শঙ্কর শাস্ত্রীসহ তাদের দলের কেন্দ্রীয় ৩ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
সর্বত্রই আশরাফের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে কর্মী পর্যন্ত- সবার ভেতরে নতুন করে উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। দলের ভেতরে-বাইরে যেসব নেতা তার ঘোরতর সমালোচক ছিলেন, সম্প্রতি তারাও চুপ হয়ে গেছেন।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মতে, এ মুহূর্তে শেখ হাসিনা বেশি আস্থা রাখছেন দলের সাধারণ সম্পাদকের ওপর। ছোটখাটো প্রায় সব দায়িত্বই এখন আশরাফের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ‘প্রফেশনাল বডির’ নেতৃত্ব যেন আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তিবর্গদের হাতে থাকে, সেটাও আশরাফকে দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে দলের সম্পাদকম-লীর নেতা বলেন, প্রতিবারই বার কাউন্সিল নির্বাচনকে সামনে রেখে দল-সমর্থিত আইনজীবীদের ভেতরে দলাদলির সৃষ্টি হয়। এর ফলে আওয়ামী লীগ ঘরানার প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়। বিষয়টি বিবেচনায় এনে এবার বার কাউন্সিল নির্বাচনের দেখভালের দায়িত্ব এবং দল-সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ী করে আনতে দায়িত্ব দিয়েছেন আশরাফকে। এরই মধ্যে আশরাফ দল-সমর্থিত আইনজীবীদের সঙ্গে কথাও বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আশরাফ দফতরবিহীন মন্ত্রী হওয়ার পরে শেখ হাসিনা আশরাফের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে একান্তে। প্রতিটি বৈঠক ছিল কয়েক ঘণ্টাব্যাপী। আর এই বৈঠকগুলোয় দলকে চাঙ্গা করাসহ সরকারের ভেতরে সমন্বয় আনার বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন দুজনে। শুধু তাই নয়, দলকে গতিশীল করতে, সময়ে-সময়ে মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে দল ও সরকারের অবস্থান জানান দিতে বলা হয়েছে। রাজনৈতিক কার্যালয়ে উপস্থিতিতি বৃদ্ধি ও সরকারি কাজে ‘সিরিয়াস’ হওয়ার বিষয়টি মূলত দলীয় প্রধানের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদকের একান্তে বৈঠকের ফল। জানা গেছে, দুজনের একান্তে এ বৈঠকে মূলত সরকারের ভেতরে ও দলের মধ্যে সমস্যা চিহ্নিত সমাধানের উপায় বের করতে ‘হোমওয়ার্ক’ করা হয়।
শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্রুত সাক্ষাতের প্রয়োজনে তার কার্যালয় ও সরকারি বাসভবনসহ সর্বত্রই আশরাফ যখন খুশি আসা-যাওয়া করতে পারবেন। এমন নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রী তার দফতর ও বাসভবনের কর্মকর্তাদের দিয়েছেন বলে তার দফতরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এর জন্য কোনও পূর্বানুমতিও লাগবে না বলেও সূত্র জানায়। গণভবনে অবস্থানকালে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে অন্য সব কেন্দ্রীয় নেতার জন্য পূর্বানুমতির প্রয়োজন রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, সাধারণ সম্পাদক আশরাফ দল ও সরকারে সক্রিয় হয়েছেন নেত্রীর নির্দেশে। তবে তিনি বলেন, আশরাফ ‘নিষ্ক্রিয়’ এমনটি পত্র-পত্রিকায় নানা সময়ে উঠে এসেছে। কিন্তু আমাদের কাছে কখনোই তাকে ‘নিষ্ক্রিয়’ মনে হয়নি। আমরা চাইলে যেকোনও সময়ে তার সঙ্গে দেখা করতে পেরেছি। অবশ্য তিনি বলেন, নেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু কাজ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন আশরাফ। শিগগিরই দলে ও সরকারে এর প্রতিফলন ঘটবে বলে আশা করি।
সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও একই ধরনের মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দলে ও সরকারে সক্রিয় আশরাফ। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সর্বত্র তার এ উপস্থিতি দলীয় কর্মীদের উৎসাহিত করবে। সংগঠন লাভবান হবে।
সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, সাধারণ সম্পাদক আশরাফের সরব উপস্থিতি আওয়ামী লীগকে গতিশীল করবে। আমি চাই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার দলীয় কর্মকা-ে সময় দেওয়ার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক। বাংলা ট্রিবিউন


শেয়ার করুন