যুদ্ধ

ad-mohammad-shajahanমূল: ভাইকুম মুহাম্মদ বশীর
অনুবাদ: মোহাম্মদ শাহজাহান

[ ভাইকুম মুহাম্মদ বশীর। সব্যসাচী ভারতীয় লেখক। ব্রিটিশ ভারতের দীর্ঘকাল কারা-নির্যাতিত স্বাধীনতা-সংগ্রামী। উপন্যাসিক, ছোটগল্পকার। সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কারসহ নিজ দেশের অধিকাংশ সাহিত্য পুরষ্কারে ভূষিত। পরলোকগত। ‘If war is to end’ শিরোনামে মূল মালয়ালম থেকে ইংরেজিতে অনুদিত ছোটগল্পটির বঙ্গানুবাদ পত্রস্থ করা হলো এখানে।]
-যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে—-। আরামদায়ক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সুঠাম দেহের লোকটি বিড়বিড় করে বলেন। একজন বিখ্যাত লেখক ও চিন্তাবিদ তিনি। বেশ বদ-মেজাজি মানুষ হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে তাঁর। ত্বকে চুলকানির রোগে ভোগছেন তিনি। মনের সুখে ত্বক চুলকোতে চুলকোতে দাঁতে দাঁত চেপে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়েন তিনি। সাক্ষাৎকার নিতে আসা তরুণ সাংবাদিককে তিনি জিজ্ঞেস করেন:
– যুদ্ধ বন্ধ করা নিয়ে আমার কী যেনো করতে হবে বলছিলে তুমি?
– এ নিয়ে আপনার কিছু করতে হবে না, স্যার। আমরা এ ব্যাপারে আপনার মতামতটুকুই জানতে চাইছি শুধু। যুদ্ধ বন্ধে আম-জনতার করণীয় কী হওয়া উচিত? সাংবাদিক বলেন।
-কিছুই করার নেই এখানে। ভালোই ভালোই কেটে পড়ো তুমি। বোকা!
– স্যার, একটা কিছু তো বলতেই হবে আপনার। বিশ্ব-পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ধ্বংসযজ্ঞ চলছে সবখানে। এসব বন্ধ হওয়া উচিত অচিরেই। আমাদের শান্তি ও কল্যাণ অর্জন করতেই হবে। আর এ নিয়েই আমরা আপনার মূল্যবান পরামর্শ আশা করছি। যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে—-?
– ওরে বোকার হদ্দ, ওরা আমার কথাতেই যুদ্ধে জড়িয়েছে নাকি? যুদ্ধ-বিগ্রহ তো প্রাচীনকাল থেকেই লেগে আছে। এখনকার মতো যুদ্ধ শেষ হলেও আবারও যুদ্ধ বাধবে অচিরেই। যাও তুমি!
– হায়! এখনও যথেষ্ঠ হয়নি? আর কোন যুদ্ধ তো কাম্য নয় মোটেই। যুদ্ধের ভয়াবহতা চিরদিনের মতো বন্ধ করতে হলে—-?
– যাও তো ভাই, অন্যদের জিজ্ঞেস করো গিয়ে। বিরক্ত করো না।
– আমরা অন্য সবার মতামত নিয়েছি। আমরা তো আপনার রগচটা স্বভাব সম্পর্কে জানিই। সেজন্যে সবার শেষে আপনার কাছেই এসেছি। আমাদের বিশ্বাস, অন্যদের চেয়ে আপনার মতামতের গুরুত্ব ঢের বেশি।
– অন্যদের মতামত কী? যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে—–?
– পৃথিবীর মানুষকে যরোরুস্ত্রের ধর্ম পালন করতে হবে, কনফুসিয়াসের নীতি অবলম্বন করতে হবে, শ্রী কৃষ্ণের বাঁশরী সঙ্গীত শ্রবণে মনোনিবেশ করতে হবে, বুদ্ধের, যীশুর, মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করে নিতে হবে। নানক তো সত্য পথের দিশা দিয়েই গেছেন ইত্যাদি।
– ও, তাই নাকি? অন্য কেউ বললো না আর কিছু? রগচটা মানুষটি মজাসে চুলকোতে চুলকোতে জিজ্ঞেস করেন।
– হ্যাঁ, বলেছেন। একদল বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে বিশ্ববাসীকে সাম্যবাদে দীক্ষিত হতে হবে। আরেকদল বলেছেন, এজন্যে আমাদের নৈরাজ্যবাদের ভক্ত হতে হবে। এক পন্ডিত তো এমনও বলেছেন যে, ফ্যাসিবাদই একমাত্র ভরসা। আবার আরেকজন বলেছেন, অহিংসার নীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে আমাদের। তো, স্যার, আপনি কী বলেন- যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে?
– তোমার তো আমাকে এ যুগের নবী বলে মানতে হবে তাহলে!
– আমি মেনে নেবো। কিন্তু অন্য কেউ কি তা মানবেন?
– তুমিই অন্যদের মেনে নিতে রাজি করাবে। তোমার পত্রিকায় খবর ছাপিয়ে দাও! ঘোষণা করে দাও যে, তুমিই আমার প্রথম শিষ্য!
– কিন্তু স্যার, আপনার কাছে কি স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ জাতীয় কিছু নাযিল হয়েছে?
– তা না তো কি? বড় বড় চোখ করে, বিকৃত মুখে সশব্দে চুলকোতে চুলকোতে লেখক বলেন।
লেখকের বসার ভঙ্গি দেখে সাংবাদিকের মনে হয়, মানুষটি পুরো বিশ্বকেই বিস্মৃত হয়ে আছেন। সাংবাদিকের গলা পরিষ্কার করে নেবার শব্দে লেখক তার দিকে তাকিয়ে বলেন:
– বেকুব কোথাকার! এখনও যাওনি তুমি?
– না স্যার। বিশ্ববাসীর প্রতি আপনার বক্তব্য আমাকে এখনও জানাননি। যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে—
– আমার অনুমান- গোপন কথাটি জানাই আছে তোমার- নিজের বউ-বাচ্চাদের আচ্ছাসে পেটালেই হয়। দেখো তো দেখি, আমার বউ-বাচ্চাদের শেষ বার পেটানোর পর বছর দেড়েক কেটে গেছে এরই মধ্যে। ভুলে গিয়েছিলাম আসলে। হ্যাঁ, কোন কিছু ভুলে গেলে যা হয় আর কি!
– কী বলছেন, স্যার? দেড় বছর যাবত ভুলে যাচ্ছেন সবকিছু?
– আরে না, বোকা! পরমানন্দ! পরমানন্দ!
– বুঝতে পারছি না।
– বলছি। গত দেড় বছরে আমি কি কোন সম্পাদক-প্রকাশকের গায়ে হাত তুলেছি?
– না।
– গত দেড় বছরে আমার নতুন কোন বই প্রকাশিত হয়েছে?
– না।
– গত দেড় বছরে আমার বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারি মামলা হয়েছে?
– সে রকম কিছু শুনিনি।
– কেনো? বোকা, কেনো?
– জানি না।
– কারণটি অনুসন্ধান করোনি কেনো? আমি কি সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের জন্যে উপযুক্ত নই?
– হ্যাঁ, আমার পত্রিকার ভুল হয়ে গেছে। আমাদের মাফ করুণ, স্যার। যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে—–
– প্রার্থনা করো গিয়ে।
– কিন্তু মানুষ তো চিরকালই প্রার্থনা করে এসেছে। তবুও তো যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। আপনার কাছে প্রেরিত প্রত্যাদেশে এ নিয়ে কী আছে তা আমাদের জানান, দয়া করে। যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে—
– চোখ থাকতে অন্ধ, কান থাকতে বধির তোমরা। বেকুব, যাও এখান থেকে।
– কিন্তু এ তো যথেষ্ঠ নয়, স্যার। আমরা সত্যিই আপনার পরামর্শের অপেক্ষায় আছি। যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে—-
– যুদ্ধ যদি বন্ধ না হয় আদৌ? কার কী এসে যায় তাতে? তোমাদের পত্রিকার কাটতি কি কমে যাবে?
-না।
– আমার বইগুলোর বিক্রি কি কমে যাবে?
– না।
– তো, এখন যেতে পারো তুমি।
– কিন্তু! আপনার পরামর্শ চাই যে আমাদের। পৃথিবীর ভবিষ্যত শান্তি ও কল্যাণ আপনার পরামর্শের উপরই নির্ভর করছে।যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে—-?
লেখক বেশ আনন্দ ও স্বস্তি নিয়ে সশব্দে চুলকোতে থাকেন। অবশেষে তিনি বলেন:
– যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে, আজকের দুনিয়ার সব রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতার, সব চিন্তাবিদের, সশস্ত্র বাহিনীর সব সদস্যের অর্থাৎ দুনিয়ার তাবৎ নারী-পুরুষেরই আমার মতো ত্বকে চুলকানির রোগে ভোগতে হবে। দিন-রাত চুলকানি হয়, এমন চর্মরোগে আক্রান্ত হতে হবে সবার।

মোহাম্মদ শাহজাহান: অনুবাদক, কলামিষ্ট ও আইনজীবী।


শেয়ার করুন