রয়টার্সের বিশ্লেষণ

যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে ইসলামভীতি ছড়ানোর আশঙ্কা

200_141সিটিএন ডেস্ক :

ক্রমবর্ধমান ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম ভীতিতে ইন্ধন যোগানোর জন্য রিপাবলিকান পার্টির জনপ্রিয় দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বেন কারসনের মন্তব্যে তীব্র ক্রোধ, ক্ষোভ ও হতাশা মিশ্রিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন আমেরিকান মুসলিমরা।

দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার অরেঞ্জ কাউন্টির ইসলামী ইনস্টিটিউটে কয়েকজন মুসলিম মা ও তাদের শিশু সন্তানদের আক্রমণ করে গালি দেয়ার ঘটনায় সেখানে ইতোমধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে।

চলতি বছর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলার বার্ষিকীতে আমেরিকান নয়- এমন একদল মা তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে ওই ইসলামী ইনস্টিটিউটে আসলে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ চিৎকার করে তাদের কাপুরুষ বলে আক্রমণ করেন। মূলত এরপর থেকেই সেখানে বিরাজ করছে চরম উত্তেজনা।

ওই ইসলামী ইনস্টিটিউটটি অ্যানাহেইম শহরে একটি স্কুল ও একটি মসজিদ পরিচালনা করে থাকে।

দেশটির ২৮ লাখ মুসলমানদের অধিকাংশই মনে করছেন, প্রেসিডেন্ট নিবার্চনের সময় চলমান এই উত্তেজনা আরো কুৎসিত আকার ধারণ করতে পারে। তারা ক্রোধ ও ধর্মান্ধতার শিকার হতে পারে বলেও ইতিমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

ফিলিস্তিন-আমেরিকান জুহাইর শাথ বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এমন কারো মুখে এই ধরনের মন্তব্য অত্যন্ত হতাশাজনক।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সির জন্য মুসলমানরা উপযোগী নয় বলে গত রবিবার মন্তব্য করেন অবসরপ্রাপ্ত নিউরোসার্জন কারসন।

প্রচারণা চালানোর সময় করা ওই মন্তব্যের সমর্থনে সোমবার কারসন বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে মুসলিমদের নিষিদ্ধ করা উচিত-এমন পরামর্শ তিনি দেননি। কিন্তু একজন মুসলিম দেশটির নেতা হোক তা তিনি চান না এবং এটা তিনি সমর্থনও করবে না।

পরে সোমবার কারসন আরো বলেন, তিনি তার নিজের মন্তব্যকে পুরোপুরিই সমর্থন করেন। এরপরেও যারা মৌলবাদী ইসলামপন্থাকে নিন্দা করেন- এমন একজন মধ্যপন্থী মুসলিম প্রার্থীর জন্য নির্বাচন উন্মুক্ত করা যেতে পারে।

২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য রিপাবলিকান দলের একাধিক প্রার্থীর মধ্যে মতামত জড়িপে কারসন শীর্ষস্থানে রয়েছেন।

কারসনের এই মন্তব্যের পর আরেক প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প শুক্রবার রাতে নিউ হ্যাম্পশায়ারে প্রচারাভিযানকালে দলটির একজন সমর্থক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে একজন মুসলমান বলে আখ্যা দেন। কিন্তু ধনকুবের ট্রাম্প ওই মন্তব্যকে মৌন সমর্থন জানান।

ট্রাম্প পরে তার নীরবতার ব্যাখ্যা দেন।

তিনি বলেন, ‘একজন শ্রোতার ভুলকে শুদ্ধ করার জন্য তিনি বাধ্য নন এবং এটি একটি বড় ইস্যু যে, দেশটিতে ওবামা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। এই দেশের জন্য খ্রিস্টানদের সমর্থন প্রয়োজন। তাদের (খ্রিস্টানদের) ধর্মীয় স্বাধীনতা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।’

দেশটির কিছু মুসলিমরা বলছেন, ওই রিপাবলিকান সমর্থকের এমন মন্তব্যে তারা শঙ্কিত। তার এই মন্তব্য কারসন এবং ট্রাম্পের বক্তব্যকেই জোরদার করবে।

তারা দুজনেই নির্বাচনে নিজেদেরকে অরাজনৈতিক প্রার্থী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তাকে লাইনচ্যুত করতে এ ধরনের ভোঁতা মন্তব্য নারী ও বিদেশি বিদ্বেষে সামান্য হলেও ইন্ধন জোগাবে। সম্ভাব্য রিপাবলিকান ভোটারদের মতামত জড়িপে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ট্রাম্প।

গত সপ্তাহে টেক্সাসের ১৪ বছর বয়সী একজন মুসলিম বালককে তার ডালাসের স্কুলে নিজের তৈরি একটি ঘড়ি আনার জন্য হাতকড়া পরিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। নিরাপত্তাকর্মীরা ঘড়িকে বোমা মনে করে তাকে গ্রেপ্তার করেন।

আহমেদ মোহামেদের গ্রেপ্তারের জন্য দেশটিতে জাতিগত বৈষ্যমের অভিযোগ ওঠে এবং তার স্কুলটি ক্ষোভের বস্তুতে পরিণত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে/ক্ষোভ প্রশমনে ওবামা মোহামেদকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান।

কাউন্সিল অব আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনের নির্বাহী পরিচালক নিহাদ আওয়াদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড় থেকে কারসনকে তার প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘কারসন নেতৃত্ব দেবার অযোগ্য। কারণ তার দৃষ্টিভঙ্গি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’

অ্যানাহেউমের আশেপাশের এলাকাকে অভিহিত করা হয় ‘লিটল আরব’ হিসাবে। ওই এলাকার বাসিন্দা আবদাল্লাহ সোয়েদান বলেন, ‘এই মন্তব্য অবশ্যম্ভাবীরূপে ঝামেলার সৃষ্টি করবে। এটা পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করে তুলছে।’ আবদাল্লাহ সোয়েদান (৫৭) প্রায় ৩৭ বছর পূর্বে লেবানন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন।

জিন্স এবং টি-শার্ট পরিহিত সোয়েদানের ১৮ বছর বয়সী ছেলে রেদওয়ান বলেন, তিনি প্রায়ই অনলাইনে মুসলিম বিরোধীদের ঘৃণাপূর্ণ লেখা পড়ে থাকেন।

কারসনের নাম উল্লেখ করে রেদওয়ান বলেন, ‘আমি জানি না একজন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী কিভাবে এমন ঘৃণাপূর্ণ কথা বলতে পারে। এটা মোটেই আমেরিকান ভাষা নয়।’

‘আমরাও ভোটার’
যদিও মার্কিন সংবিধানে নির্বাচনী প্রচারে ধর্ম নিয়ে কটাক্ষের ব্যাপারে বিধিনিষেধ রয়েছে এবং প্রেসিডেন্টশিয়াল রাজনীতিতে এর মিশ্র ব্যবহারও রয়েছে।

২০০৭ সালে রিপাবলিকান মিট রমনি তার নিজ দলের মনোনয়নের জন্য প্রচারণার সময় তার মরমন বিশ্বাসের জন্য ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানদের সম্মুখীন হতে হুমকি পেয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে জন এফ কেনেডি গির্জার বিচ্ছেদের ওপর জোর দেন এবং এই প্রচারণা চালিয়েই তিনি দেশটির প্রথম রোমান ক্যাথলিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

আইচা ফোকার (২০) এক ব্যক্তি কারসনের মন্তব্যকে চিরন্তন উল্লেখ করে বলেন, ‘এটি সত্যিকার অর্থেই অসুস্থ বাঁধাধরা নিয়ম যা আমেরিকান সংস্কৃতিতে নিহিত রয়েছে।’

টেক্সাস এন লাভবকের এক ছাত্র বলেন, ‘এটা তরুণ মুসলিমদের তাদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে নিরুৎসাহিত করছে অথবা তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে গর্বিত করে তুলছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এমন মন্তব্য করে তারা সবাই চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব বেশি ভোট আদায় করতে। আমাদের কি হবে-আমার মনে হয় না, তারা এটা বুঝে। তারা এটা বুঝতে পারে না যে, আমরা মুসলমানরাও ভোটার।’

দেশটির বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার শহর ডেট্রয়েটরে শহরতলী ডিয়ারবর্নের বাসিন্দা মার্শাল শাহমেরি জানান, ইসলামের ভুল ধারণা দূরীভূত করতে ট্রাম্প আরো অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু তিনি এই মন্তব্যগুলোকে তার বিশ্বাসের উপর আক্রমন হিসাবে দেখতে পারে না।

মূলত ইরাক থেকে আসা শাহমেরি বলেন. ‘একজন প্রার্থী হিসাবে, একজন ব্যবসায়ী হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে তাকে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ হওয়া উচিত এবং এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া আরো স্পষ্ট করা উচিৎ।’

ডেট্রয়েট শহরতলীর আরেক এলাকা স্টার্লিং হাইটসেও মুসলিম বিরোধী উত্তেজনা চলছে। শহরটির আবাসিক এলাকার একটি মসজিদের উন্নয়নের জন্য চলতি মাসে একটি ইসলামী দল সরকারী কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানায়। কিন্তু শহরটির সরকারী কর্মকর্তারা তা করতে অস্বীকার করলে সেখানে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।

এ নিয়ে মসজিদের সমর্থকরা প্রতিবাদ করলে তারা ওই কর্মকর্তাদের হাতে নাজেহাল হন। তাদের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে অভিযোগ করে-তা তদন্তের অনুরোধ জানিয়ে মুসলিমরা সোমবার মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসে একটি পিটিশন দায়ের করেন।

গত সপ্তাহে কেনটাকিতেও এমন উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। ওই এলাকার একটি মসজিদে লাল রং দিয়ে মুসলমান বিরোধী বিভিন্ন মন্তব্য লিখে মসজিদটির সৌন্দর্য নষ্ট করা হয়। এতে লেখা হয়, ‘মুসলিমরা ইহুদিদের একাকী থাকতে দাও’, ‘এ জন্যই ফ্রান্স’ এবং ‘নাৎসিরা আরবিতে কথা বলে’।

লুইসভিলে ইসলামিক সেন্টারের প্রধান ওয়াহিদ আহমেদ জানান, মসজিদটিতে ভাংচুরের জন্য একদল বদমাইশ দায়ী; যারা ওই সময় মাতাল অবস্থায় ছিলেন।

টেক্সাসের টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাবা নাফীস (২৩) কারসনের মন্তব্যে কিছু বিদ্রূপ খুঁজে পেয়েছেন।

তিনি বলছিলেন, ‘মিডিয়াতে যা চিত্রিত হচ্ছে, তা চরমপন্থা ছাড়া কিছু নয়। যে অজুহাতে ইসলামকে ভুল বোঝা হচ্ছে, ইসলাম আসলে তেমনটি নয়।’

সূত্র: রয়টার্স


শেয়ার করুন